চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
ঐতিহ্যদীপ্ত আধুনিকতার শুরু কিন্তু এই বাংলায়
শিল্পকলার সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলার আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা প্রায় বরাবরই যথেষ্ট ব্রাত্য থেকে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে আধুনিক শিল্পকলার যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তাতে পশ্চিম-ভারত ও উত্তর-ভারত যে গুরুত্ব পেয়েছে পূর্ব-ভারত সে তুলনায় কিছুই পায়নি। অথচ এটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ঐতিহ্যদীপ্ত আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল এই বাংলা থেকেই। আমাদের প্রথম আধুনিকতাবাদী শিল্পী রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জন্মশতবর্ষে এ বিষয়ে কিছু সচেতনতা জাগে। কিন্তু এই বাংলায় রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার যে বিস্তার তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আজও অনেকটাই ছায়াচ্ছন্ন। ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ তৈরি হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৭ সালে ‘বম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রুপ’ গড়ে ওঠার পিছনে ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’-এর কিছু প্রভাব ছিল। অথচ আজও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদের বিকাশে ‘বম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রুপ’-এর শিল্পীদের যে স্বীকৃতি, ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’-এর শিল্পীরা সেই তুলনায় অনেকটাই ম্লান।
এর পিছনে বাংলার সমাজনীতি ও রাজনীতির ভূমিকাও কিছু কম নেই। আজ দিল্লির কোনও আর্ট গ্যালারি যখন বাংলার শিল্পীদের শনাক্ত করে তাঁদের কাজ কিনে নিয়ে যাচ্ছে, প্রদর্শনী করছে, ক্যাটালগ তৈরি করছে, তখন আমরা জানছি যে তাঁরা বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। বাংলা থেকে সে রকম কোনও উদ্যোগ আজও গড়ে ওঠেনি।
শিল্পী: গোবর্ধন আশ।
এই কথাগুলো মনে হচ্ছিল গ্যালারি ৮৮-তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গোবর্ধন আশের (১৯০৭-১৯৯৬) নিসর্গচিত্রের প্রদর্শনী দেখতে দেখতে। এর আগে বিক্ষিপ্ত ভাবে তাঁর নিসর্গরচনা আমরা কিছু কিছু দেখেছি। কিন্তু এখানে বিভিন্ন সময়ে করা ৬০টিরও বেশি ছবি একসঙ্গে দেখতে দেখতে তাঁর নিসর্গরচনার বিবর্তন বুঝতে পারি। এ রকম এক জন শিল্পীর সঠিক মূল্যায়ন এখনও সেভাবে হয়নি। ক্যালকাটা গ্রুপের শিল্পী ছিলেন তিনি। আধুনিকতাবাদের বিকাশে এই গ্রুপের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আলোচ্য প্রদর্শনী থেকেও তার কিছু আভাস আমরা পাই।
গোবর্ধন আশের জন্ম হুগলি জেলার বেগমপুর গ্রামে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সারা জীবন তিনি এখানেই কাটিয়েছেন। ছবি আঁকা শিখেছেন প্রথমে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে (১৯২৬-১৯৩০), তার পর ১৯৩২ থেকে মাদ্রাজের সরকারি আর্ট স্কুলে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর অধীনে। শিল্পকলার সংগঠক হিসেবেও তাঁর বিশেষ অবদান আছে। ১৯৩১-এ গড়ে ওঠা ‘ইয়ং আর্টিস্টস ইউনিয়ন’, ১৯৩৩-এর ‘আর্ট রিবেল সেন্টার’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ গড়ে ওঠার পর এই দলের সক্রিয় সদস্য হন। মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ছবির ভিতর তাঁর প্রতিবাদী চেতনা বিধৃত আছে।
তাঁর নিসর্গ রচনাগুলির মধ্যে এক দিকে যেমন তাঁর দেশ-কাল চেতনার পরিচয় আছে, তেমনই আছে তাঁর নৈর্ব্যক্তিক সৌন্দর্যপিপাসু মরমি কবিমনের পরিচয়। চল্লিশের শিল্পীদের একটি বৈশিষ্ট্য, তাঁরা দু’টি উৎসের সমন্বয়ে তাঁদের আঙ্গিক গড়ে তুলতে চেয়েছেন। দেশীয় লৌকিক ও পাশ্চাত্যের আধুনিক আঙ্গিক। গোবর্ধন আশের ছবিতেও এই বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। স্বাভাবিকতাবাদী রীতিতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। ক্রমান্বয়ে প্রতিচ্ছায়াবাদী ও উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদী রীতিতে তিনি স্বাভাবিকতাকে বিশ্লিষ্ট ও রূপান্তরিত করে নেন। তাঁর নিসর্গের আঙ্গিকে এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। অবনীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর হয়ে গোপাল ঘোষ পর্যন্ত বাংলার নিসর্গরচনার যে ধারা সেখানে আলোচ্য শিল্পীর একটি স্বকীয় অবস্থান আছে। উল্লিখিত শিল্পীদের কারও সঙ্গেই তাঁর ছবির বিশেষ মিল নেই। কেবল মাত্র কোনও কোনও ক্ষেত্রে গোপাল ঘোষের ছবির সঙ্গে কিছু সাযুজ্য অনুভব করা যায়। ১৯৩৮-এর ‘বস্তি’ শিরোনামের যে ছবি সেখানে গ্রামের ভাঙা কুটিরের রূপায়ণে স্বাভাবিকতাবাদী রীতির কিছু অনুষঙ্গ আছে। এটাকে তিনি অতিক্রম করে গেছেন। ১৯৫৪-র ‘আউট অব ভিলেজ’ শীর্ষক ছবিতে তার পরিচয় আছে। ১৯৯৪-তে আঁকা যে ছবিটি দেখছি আমরা এই লেখার সঙ্গে সেখানে সমগ্র পরিসর জুড়ে যে মায়াবী আলো, তাতে ধরা থাকে এই শিল্পীর অন্তর্দীপ্ত কবিমনের পরিচয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.