যখন জঙ্গলের ক্যাম্পে পৌঁছলাম তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। কোনও রকমে মালপত্র রেখেই চেপে বসলাম গাড়িতে। জঙ্গল দেখার লোভ সামলানো যাচ্ছিল না। আলো অনেকটাই কমে এসেছে। দূরে পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে সূর্য যাই যাই করছে। জঙ্গলে মট মট শব্দ হচ্ছিল। পাহাড়ের ও দিকে সূর্যাস্তের প্রস্তুতি দেখতে এত মোহিত ছিলাম যে দু’দিকে কী হচ্ছে খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল দূরের ধূসর পাহাড়টা সামনে চলে এসেছে।
সম্বিত ফিরতেই বুঝলাম ওটা একটা পাহাড়প্রমাণ হাতি। বিশাল দুটি দাঁত। গাড়ির দিকে শুঁড় উঁচিয়ে ছুটে আসছে। কিছুটা এসে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ির ঠিক সামনে রাস্তা আটকে। আশপাশের জঙ্গলে তখনও মটমট শব্দ। দেখলাম এক পাল হাতি গাছের ডাল ভাঙছে। দলে রয়েছে কয়েকটা বাচ্চাও। সেগুলো বার বার চলে আসছে রাস্তার উপরে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাদের দাদা দিদি-রা ফের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলে। দেখলাম দলে অন্তত ১০টি প্রমাণ সাইজের হাতি। প্রত্যেকেরই ইয়া বড় বড় দাঁত।
ভারতে যে সব হাতির পাল দেখেছি তাতে মাদী হাতিরাই শুধু থাকে। দলের নেতৃত্বও দেয় মাদী হাতিই। কিন্তু আফ্রিকায় দলে পুরুষ হাতির আধিক্য কেন? প্রধানও পুরুষ হাতি কেন? এখানে হাতির সমাজতন্ত্র কি আলাদা? |
সঙ্গে থাকা ফরেস্ট গাইড ম্যাখায়া বললেন, “ওগুলো আসলে মাদী হাতিই। আফ্রিকার হাতির পুরুষ ও মাদী দু’জনেরই বড় দাঁত থাকে। তবে পুরুষের দাঁত অপেক্ষাকৃত বড় হয়। এখানেও পুরুষ হাতি দলছুট থাকে।”
আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ম্যান্ডেলার দেশের জুলু-নাটাল প্রদেশের ঠান্ডা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে এক সময় গোটা হাতির দলটা পেরিয়ে গেল। হাতে ক্যামেরা। কিন্তু ছবি তুলতে পারছি না। কারণ, সব আড়াল করে দাঁড়িয়ে দলনেত্রী। গোটা দলটা বেরিয়ে যাওয়ার পরে দলনেত্রী আমাদের গাড়ির সামনে থেকে সরলেন। পুরো দলটা মট মট করে গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে যখন অনেকটা এগিয়ে গেল তখন স্টার্ট দিল গাড়ি। কিন্তু কিছুটা দূরে গিয়ে ফের স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন চালক থিও।
গাইড ম্যাখায়া বললেন, বাঁ দিকের জঙ্গলের দিকে নজর রাখুন। তখন সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে। আকাশে তার লালচে আভা। আমরা দেখলাম একটা দানবকে। উচ্চতায় অন্তত ৪ মিটার। বিশাল দুটি দাঁত কাঁটার জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। শুঁড় উঁচিয়ে সে ভাঙছে উঁচু একটা গাছের ডাল। কিন্তু বার বার মগডালটা পিছলে যাচ্ছে। রেগে গিয়ে ওই দানব মাথা দিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল
গাছের গুঁড়িটাকেই। মড় মড় করে আওয়াজ উঠল। তার পরে কী মনে করে ওই হাতিটা একটু একটু করে সেঁধিয়ে গেল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। ম্যাখায়া বললেন, “এটাই এ জঙ্গলের সব থেকে বড় পুরুষ। ওজন কম করে ৬০০০ কিলো। ওটা বদরাগী। চার্জ করতে পারত।”
হাতির পালের জন্য রাস্তায় আটকে থাকার অভিজ্ঞতা এর আগেও আমার হয়েছে। একাকী ঘুরে বেড়ানো দাঁতাল যে কতটা ভয়ঙ্কর তা বুঝেছি ডুয়ার্সে। তাড়া খেয়ে গাড়িতে ফুল স্পিড তুলে চটপট সরে যেতে হয়েছে হাতির সামনে থেকে। দলের স্ত্রী হাতিগুলিকে তেমন ভয় না লাগলেও, দাঁতাল পুরুষগুলির ভাবভঙ্গি পিলে চমকে দেওয়ার মতোই। তখন এক ফরেস্ট অফিসার মন্তব্য করেছিলেন, “এদের দেখেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন, আফ্রিকার হাতির সামনে পড়লে কী করবেন!”
আমরা যে ক্যাম্পে তিন দিন ছিলাম তার চার পাশটা বিদ্যুৎবাহী তার দিয়ে ঘেরা। রাতে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায় ওই তার দিয়ে। এক রাতে ডালপালা ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি বড় একটা হাতির পাল নৈশভোজ সারছে। ডাকও ছাড়ছে কেউ কেউ।
পর দিন ভোরে ম্যাখায়াকে গত রাতের ঘটনাটা বলতে ম্যাখায়া বললেন, “ওই তারে যে বিদ্যুৎ যাচ্ছে তা দলের অভিজ্ঞরা জানে। তাই অনভিজ্ঞদের সতর্ক করছিল ওরা।”
ম্যাখায়া বললেন, “দলে একে অন্যের সিগন্যাল হাতিরা খুব ভাল বোঝে। এতদিন ধরে এই জঙ্গলে ঘুরছি। এক দিনও দেখলাম না একটা হাতি তার স্পর্শ করেছে। কোনও এটা হাতি এক বার শক খেয়েছিল। বাকিরা সেই বার্তা পেয়ে গিয়েছে।” |