রিষড়ার লেনিন মাঠে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করে। বিভিন্ন সময় সেখানে ফুটবল-ক্রিকেট-সহ নানা প্রতিযোগিতাও হয়। অথচ এখানেও ফি বছর জগদ্ধাত্রী পুজোয় মাঠ জুড়ে মেলা বসে। নাগরদোলা বা বিরিয়ানির অস্থায়ী স্টল ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয় সবুজ ঘাসের বুকে। বাঁশ-কাঠ মাঠ থেকে সরেছে। কিন্তু আদৌ কি তা খেলার উপযোগী হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। স্থানীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। শুধু রিষড়াই নয়, হুগলির বিভিন্ন মাঠেই চোখে পড়ে এই ছবি।
উত্তরপাড়া স্টেশন সংলগ্ন সিএ মাঠ (মনমোহন উদ্যান) থেকে দুর্গাপুজোর বাঁশ, প্লাইউড, কাঠকুটো সরানো হয়নি। দুর্গাপুজোর সেই বাঁশ-কাঠ, দিয়েই সেখানে তৈরি হচ্ছে অন্য একটি মেলার ম্যারাপ। খেলাধূলা লাটে। এবড়ো-খেবড়ো মাঠ বেহাল জিটি রোডকেও লজ্জা দেবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানালেন, প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের ‘সমঝে’ চলেন সকলে। তাই প্রতিবাদ হয় না। বৈদ্যবাটি বিএসপার্ক মাঠে প্রায়শই নানা অনুষ্ঠান হয়। স্থানীয় পুরসভা এবং পুলিশ আয়োজিত শারদ সম্মান অনুষ্ঠান ওই মাঠেই হয়েছে।
মাঠের মধ্যে হাজার হাজার লোক বসে অনুষ্ঠান দেখলে তাতে যে মাঠের দফারফা হয়ে যায়, সে কথা কেউই অস্বীকার করছেন না। বিএস পার্ক ক্লাবের তরফে জানানো হয়, মাঠের ভিতরে সাধারণত কোনও অনুষ্ঠান হয় না। উদ্যোক্তারা মাঠের যেটুকু ক্ষতি হবে তা সারিয়ে দেবেন বলেছিলেন। সেই কাজ হচ্ছেও। |
ডানকুনি ফুটবল মাঠের হালও খারাপ। উদ্যোক্তারা মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ করেন ঠিকই। কিন্তু পুজো, রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে সারা বছর সরগরম থাকে ওই মাঠ।
১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জয়ী মোহনবাগান দলের সদস্য ছিলেন উত্তরপাড়ার মনমোহন মুখোপাধ্যায়। তাঁর নামাঙ্কিত উত্তরপাড়া স্টেশন সংলগ্ন মাঠে এখন আর ফুটবল পায়ে দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ নেই কচিকাঁচাদের। মুখ গোমড়া প্রাতর্ভ্রমণকারীদেরও। মাঠে বিশাল মণ্ডপ করে দুর্গাপুজো হয়েছিল। সেই বাঁশ-কাপড় এই সে দিন পর্যন্ত সরেনি। কেননা, দিন দু’য়েক পরে এই মাঠেই শুরু হচ্ছে আরও একটি মেলা। মাঠ নিয়ে অসচেতনতার সুযোগ নিচ্ছে ডেকরেটর সংস্থাও। পরিবহণ খরচ বাঁচাতে জন্য দুর্গাপুজোর বাঁশ-কাঠ মাঠ থেকে সরায়নি তারা। আর মাঠের হাল? অনেক জায়গাতেই ঘাসের অস্তিত্ব নেই। কিছু অংশ দেখলে মনে হবে, পুরুলিয়ার খটখটে চাষজমি। আর মেলা শেষ হওয়ার পরে মাঠের চেহারা যে আরও খারাপ হবে, তা বলার অবকাশ রাখে না। এখনও অবশ্য রোজই ছেলেরা গা ঘামায়। তবে, কার্যত সাইডলাইনের বাইরে। একই হাল শহরের বিএ মাঠেরও। এই মাঠটিও দেখভালের দায়িত্ব পুরসভার। এই মাঠেও স্থানীয় একটি পুজো উদ্যোক্তারা বিশাল মণ্ডপ বেধে পুজো করেন। অথচ দু’টি ক্ষেত্রেই মাঠ বাঁচিয়ে অনায়াসে পুজো করা যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি।
শুধু কচিকাঁচারাই নয়, মাঠের এই দশায় প্রাণ ওষ্ঠাগত সকাল-বিকেল মাঠে হাঁটতে আসা প্রবীণ নাগরিকদেরও। অনেকেই বলেন, “ডাক্তারের পরামর্শে প্রাণের দায়ে আমরা হাঁটতে আসি। মাঠে দু’দণ্ড বিশ্রাম বা শরীরচর্চা করেন অনেকেই। কিন্তু মাঠের যা অবস্থা, তাতে ভাল ভাবে হাঁটা যায় কই! আর মাঠে বসা তো ক্রমশ কষ্টকল্পনা হয়ে উঠছে। কাকে বলব!”
মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় পুরসভা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, খেলাধুলো বাঁচাতে তারা কতটা আন্তরিক।
সিএ মাঠে দুর্গাপুজো কমিটির এক কর্তা অবশ্য বলেন, “আগে তো বাইরেই পুজো হত। এখন মাঠে সারা বছর অনুষ্ঠান লেগে থাকে। মাঠের অবস্থা ভাল নয়, এটা ঠিক। মাঠ বাঁচাতে প্রয়োজনে পুজো আমরা বাইরেও করতে পারি।”
উত্তরপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যান-ইন-কাউন্সিল দিলীপ যাদব বলেন, “বইমেলা শেষ হলেই দ্রুততার সঙ্গে মাঠ খেলার উপযোগী করে দেওয়া হয়। বইমেলার কারণে মাঠের কোনও ক্ষতি হয় না।” উত্তরপাড়া থেকে রিষড়া বা বৈদ্যবাটি সর্বত্রই দাবি উঠেছে মেলার স্থায়ী জায়গা হোক শহরে। খেলার মাঠে শুধু খেলাই হোক। নাগরিকদের বক্তব্য, কলকাতা ময়দান থেকে যদি বইমেলা-সহ অন্যান্য মেলা উঠে গিয়ে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে হতে পারে, তবে এখানেই বা কেন অন্য ভাবে ভাবা হচ্ছে না? ঘটনা হচ্ছে, উত্তরপাড়া কোঅপারেটিভ ট্রেনিং সেন্টারের মধ্যে আগে মেলা হত। উত্তরপাড়া শহরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “সিএ মাঠে বইমেলা-সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা চাই এই ধরনের মেলা হোক শহরে। এটা অত্যন্ত ভাল উদ্যোগ। কিন্তু খেলার মাঠ বাঁচাতে জায়গা পরিবর্তনের কথা ভাবা হোক।” |