প্রবন্ধ...
ঘরের লোক মারলে লাগে না বুঝি?
থেঘাটে মেয়েদের নির্যাতন আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রকে খুবই চিন্তিত করে তুলেছে। মেয়েদের জন্য ‘ন্যায়দেবতা’র প্রতিষ্ঠায় বিশেষ আগ্রহী আমাদের সরকার। জন্ম থেকেই মেয়েদের বাড়ির বাইরের অত্যাচার নিয়ে সাবধানবাণী শুনতে হয়, আজকাল সেটা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে মেয়েদের বাড়ির বাইরের কাজে যোগ দিতেও নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ঘরের ভিতরে মেয়েদের অবস্থা বিষয়ে সকলেরই মুখে যেন কুলুপ আঁটা, নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত। কেন?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০১২ সালে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দ্বারা মেয়েদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ১,০৬,৫২৭। ২০১১ থেকে ৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই নির্যাতন। আর আমাদের রাজ্যে এই বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ। বৃদ্ধি অনুসারে সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই প্রথম। মেয়েদের ওপর অন্যান্য সব ধরনের অপরাধের মধ্যে গার্হস্থ্য নির্যাতনই সংখ্যায় সব থেকে বেশি। তা-ও শ্বশুরবাড়িতে পণজনিত কারণে মৃত্যু এই সংখ্যার আওতায় আসে না। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, খুব কম মেয়েই স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির দুর্ব্যবহারের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন, আইনের দ্বারস্থ হওয়া তো দূর অস্ত্। আর সংখ্যার তারতম্য থাকলেও মেয়েরা বাপের বাড়িতেও অত্যাচারিত হন। অর্থাৎ, এন সি আর বি ঘোষিত এই সংখ্যার বাইরেও একটা বিরাট অংশের মেয়ে আছেন, যাঁদের ওপর পরিবারের নির্যাতনের কথা অনুচ্চারিতই থেকে যায়।
গার্হস্থ্য অত্যাচারে নির্যাতনকারীরা সাধারণত নির্যাতিতার আত্মীয়-পরিজন। আমাদের সমাজে গার্হস্থ্য নির্যাতন এতটাই মজ্জাগত যে, বেশির ভাগ মানুষই এতে দোষের কিছু দেখতে পান না। পুলিশ-প্রশাসনও হামেশাই বলে থাকে, স্বামী একটা চড় মেরেছে বলে পুলিশের কাছে ছুটে আসতে হবে? এ আবার কেমন মেয়ে রে বাবা! ইউনিফেম-এর ২০১১ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে ২০১০-এ ২৩.৯ শতাংশ মেয়ে পরিবারের মধ্যে শারীরিক এবং যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। আর ৩৭.২ শতাংশ মেয়ে সারা জীবনে কখনও না কখনও এ ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। বেশির ভাগ সময়ই এই অত্যাচার এসেছে স্বামী অথবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের থেকে। জাতীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার সমীক্ষা (২০০৫-০৬) অনুযায়ী, ৬২ শতাংশ মেয়ে জানিয়েছেন, বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই তাঁরা শারীরিক এবং যৌন হিংসার সম্মুখীন হয়েছেন। যদিও পারিবারিক নির্যাতন রোধে ২০০৫ সালে নতুন আইন চালু হয়েছে, তারও আগে ১৯৮৩ সালে স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন তৈরি হয়েছে, তথাপি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গাফিলতি এবং মেয়েদের পায়ের তলায় রাখার মূল্যবোধ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে একটি বড় অন্তরায়।
গার্হস্থ্য নির্যাতনের রকমফের আছে। মারধর, গালাগাল, যৌন অত্যাচার— পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে মেয়েদের উপরে এ সব নিত্য ঘটে। অত্যাচারের ধরন যা-ই হোক না কেন, ফল একটাই— নির্যাতিতার চরম অপমান, আত্মবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত। আর এটাই নির্যাতনের উদ্দেশ্য। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস যত তলানিতে ঠেকবে, ততই তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হবে।
মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কেন প্রয়োজনীয়? অনেকাংশেই তাদের গতরের জন্য। বিনা পয়সায় এবং স্বীকৃতিতে এত খাটুনি আর কে খাটবে, মেয়েরা ছাড়া? কখনও ভালবাসার ছলে, কখনও পিটিয়ে মেয়েদের শ্রম নিঙড়ে নেয় পরিবার, সমাজ। সরকারও এ বিষয়ে পরিবারকে পূর্ণ সহায়তা করে। সরকারি পরিভাষায় ঘরের মধ্যে মেয়েদের এই গাধার খাটুনির নাম দেওয়া হয়েছে ‘গার্হস্থ্য কর্তব্য’! ২০০৯-১০-এ জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এন এস এস) তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে ও শহরে প্রতি হাজারে ‘গার্হস্থ্য কর্তব্যে’ নিয়োজিত মেয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৪৭ এবং ৪৬৫। অথচ ওই একই ‘কর্তব্যে’ নিয়োজিত প্রতি হাজারে পুরুষের সংখ্যা গ্রামে ৫ জন এবং শহরে ৪ জন। ২০০৯-১০-এ ভারতে মোট ২১ কোটি ৬০ লক্ষ নারী ‘গার্হস্থ্য কর্তব্যে’ যুক্ত ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই ঘরে বসে কিছু না কিছু রোজগার করেন, কিন্তু খাতায়-কলমে দেশের শ্রমশক্তির খতিয়ান থেকে বাদ পড়ে যান। কারণ, এই রোজগার মেয়েরা বিনা প্রশ্নে বাবা-দাদা-স্বামীর হাতে তুলে দেন এবং তা মোট পারিবারিক আয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মেয়েদের ঘরে বসে আয় মানে— রোজগারও হল আবার ‘গার্হস্থ্য কর্তব্য’-এরও কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি হল না। পরিবারে ক্ষমতার সিঁড়িতে যারা উপরতলার বাসিন্দা, তাদের আরাম-আয়েস, বাড়া ভাত, হাতের কাছে পান-তামাক— সব সুখই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহাল রইল, এর থেকে সুখের কথা আর কী হতে পারে!
আমাদের শহর-ঘেঁষা একটি গ্রামে একটি মেয়ে বিড়ি বেঁধে উপার্জনের টাকায় নিজের জন্য একটি শাড়ি কিনেছিলেন। তাঁর স্বামী বাড়ি ফিরে শাড়িটি দেখে জানতে চান, কার শাড়ি। মেয়েটি সরল মনে সত্যি কথা বলে স্বামীর জলখাবার বানাতে রান্নাঘরে যান। জলখাবার নিয়ে ফিরে দেখেন শাড়িটি কুচি কুচি করে কাটা হয়েছে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া শাড়ি কিনবে কেন স্ত্রী? পারিবারিক নির্যাতনের এমন চরম নিদর্শন মোটেই বিরল নয়। মেয়েরা ঘরে বসে রোজগার করলে এই ধারা চলবে। খাটুনি, নির্যাতন, রোজগারের টাকা বেদখল হয়ে যাওয়ার চক্রব্যূহ থেকে কোনও উপায় থাকবে না।
এমন নয় যে, যে মেয়েরা বাইরে কাজে যান, তাঁদের ঘরের কাজ কিছু কম করতে হয়, কিংবা তাঁরা নিজেদের উপার্জনের টাকা যথেচ্ছ খরচ করতে পারেন, কিংবা তাঁরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন না। তবু, তাঁদের ঘরের বাইরে একটু নিশ্বাস ফেলার অবকাশ মেলে। পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা হয়, বাইরের জগতের খবরাখবর পাওয়া যায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ফলে প্রতিরোধের ক্ষমতাও গড়ে ওঠে। অন্তত পারিবারিক উপার্জন থেকে নিজের উপার্জনকে তাঁরা আলাদা ভাবে দেখতে পান। চাইলে কিছু টাকা নিজের জন্য সরিয়েও রাখতে পারেন।
কেউ কেউ বলছেন, আজকাল মেয়েরা নিজেরাই ঘরে বসে কাজ করতে চাইছেন। চাইছেন হয়তো। কিন্তু কেন চাইছেন, সেটা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। বাড়ির অশান্তির ভয় পান মেয়েরা। মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেশি সময় কাটালে নাকি পারিবারিক সম্মানহানি ঘটে। বাবা-স্বামীর সম্মানের জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেন, এমন মেয়ে আজও আকছার দেখা যায়। এ ছাড়া বাইরে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের সারাক্ষণ পায়ে বেড়ি পরানোর চেষ্টা চলছে। প্রাক্তন বলিউড অভিনেত্রী তথা সাংসদ থেকে শুরু করে অনেক নেতা-মন্ত্রীই মেয়েদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন। ঘরের লোকের মারে যেন গায়ে ব্যথা কম লাগে! কম অপমান হয়! সর্বোপরি, ঘরের কাজ সামলে বাইরের কাজে যোগ দেওয়ায় মেয়েদের কায়িক পরিশ্রম প্রচণ্ড বেড়ে যায়। কাজের জায়গায় যাওয়াটাই কম শ্রমসাধ্য ব্যাপার নয়। যে মেয়েরা শহরতলি থেকে রোজ সব্জি বিক্রি করতে কিংবা বাবুর বাড়ি কাজ করতে আসেন, তাঁরা অনেকেই রাত তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরোন। হেঁটে, ভ্যান-রিকশা চড়ে, ট্রেনে চেপে শহরে পৌঁছন। বাড়ি বসে কাজ করলে তাঁর অন্তত একটু শারীরিক খাটুনি বাঁচত!
কিন্তু এর সমাধান এই নয় যে, মেয়েদের রান্নাঘরে ফেরত পাঠাও। আমাদের রাষ্ট্র যদিও তা-ই চায়। মেয়েরা যত ঘরে বসে গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত থাকবে, ততই সরকারের খরচ কমবে। মেয়েরা বাইরে বেরোলে পরিবারের বাচ্চা এবং বুড়োমানুষদের দেখার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সরকারের উপরে চাপ বাড়বে। সরকারি প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও কর্মরতা মায়েদের জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা না করে এখনও পার পাচ্ছে সরকার। বেশি বেশি মেয়েরা বাইরে কাজে বেরোলে এ দাবি উঠবেই। বুড়োমানুষদের দেখভালের জন্যও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এ সবের থেকে মেয়েদের ঘরবন্দি করা অনেক সোজা! কিন্তু টাকার দরকার মেয়েদেরও। অবশ্যই দরকার! মেয়েদের রোজগারেই তো সংসারের শ্রী ফেরে, সরকারেরও জাতীয় আয়ের ভাণ্ডার ভরে। অতএব বাড়ি বসে কাজ করুক মেয়েরা, আর বন্ধ দরজার আড়ালে স্বামী-শ্বশুরের লাথি-ঝাঁটা খাক!
নাগরিক সমাজ, প্রচারমাধ্যম কেউই কিন্তু এ ব্যবস্থার তেমন জোরালো বিরোধিতা করছেন না। বলছেন না, মেয়েদের ঘরের অত্যাচার কমানোর জন্য বেশি বেশি করে বাইরের কাজে যোগ দিতে হবে। তার জন্য পরিবারের পুরুষদেরও ঘরের কাজের সমান দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারকে মেয়েদের পরিশ্রম কমানোর জন্য পাড়ায় পাড়ায় ক্রেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে, হাতের কাছে সুলভ পরিবহণ মজুত রাখতে হবে। এ নিয়ে একটিও দাবিসনদ নেই। কেন? ঘরের মধ্যেকার ঘটনা কি শুধুই ঘরের? দেশের নয়? সমাজের নয়? নির্যাতিতা, ঘর-শ্রমিক মেয়ে কি স্বামী-বাপ-দাদার সম্পত্তি? পূর্ণ নাগরিক নন? তাঁর ভোটে কি রাজনৈতিক দলগুলির ভাগ্য নির্ণয় হয় না? তাঁর সাংসারিক এবং অর্থকরী শ্রমে কি দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয় না? না কি, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ, সবাই নারীর প্রতি অপরাধের ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধা মতো এক চোখ বন্ধ রেখেই চলবেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.