পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ৭৫ বর্ষপূর্তির সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকিয়া বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস গণতন্ত্রের অমর্যাদা করিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ ডুবাইলেন। সম্ভবত তাঁহারা নিজেরাও সেই সত্য সম্পর্কে অবহিত। অবহিত বলিয়াই জোর গলায় শাসক দলের বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্য’র তোপ দাগিয়াছেন। তাঁহাদের অভিযোগ যে অমূলক, এমন কথা বলা চলে না। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এমন একটি অনুষ্ঠানে কেন আমন্ত্রিত হইলেন না, তাহার সদুত্তর শাসক দলের ঝুলিতে নাই। বস্তুত, অনুষ্ঠানের দিনটিতে সমস্ত পক্ষই যে ভাবে ‘সৌজন্য’ ‘সৌজন্য’ বলিয়া পাড়া মাথায় করিয়াছেন, তাহাতে সুরসিক ইংরেজ লেখক স্টিফেন লিকক লিখিত সুসমাচারটি মনে পড়ে: নিজে কাচের ঘরে বাস করিলে ক্রমাগত অন্যের প্রতি ঢিল ছুড়িয়া যাইবে! সৌজন্য নয়, রাজ্য বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী অসৌজন্যের প্রতিযোগিতায় কলঙ্কিত হইয়া থাকিল। ইহা দুর্ভাগ্যজনক।
দুর্ভাগ্যজনক এই কারণে যে, এতদ্দ্বারা বিধানসভার মর্যাদা অপেক্ষা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ গুরুতর বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। বিধানসভার বর্ষপূর্তি উদ্যাপন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে একটি বৃহৎ উপলক্ষ। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও রীতিপদ্ধতি পরিষদীয় নিয়মতন্ত্রকে কী ভাবে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে, এ ধরনের উপলক্ষের উদ্যাপন তাহারই স্মারক। ইহাতে অংশগ্রহণ করিয়া সব দলই পরিষদীয় গণতন্ত্রের প্রতি নূতন করিয়া আপন আস্থা জ্ঞাপন করার সুযোগ পায়। রাজ্যের কংগ্রেস ও বামপন্থী বিধায়করা স্বেচ্ছায় সেই সুযোগ হাতছাড়া করিতেছেন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির তাড়নায়। শাসক দল তাঁহাদের অর্থাৎ পরিষদীয় বিরোধী পক্ষকে যথোচিত গুরুত্ব দিতেছে না, প্রশ্নোত্তর পর্ব হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে বিরোধীদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতেছে না— এমন অভিযোগ আছে। বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে মন্ত্রীরা সভায় পারতপক্ষে হাজির থাকেন না, শাসক দলের বিধায়কদের প্রশ্নগুলি সামনে রাখিয়া বিরোধীদের প্রশ্নগুলি তালিকার শেষের দিকে রাখা হয় এবং দায়সারা ভাবে উত্তর দেওয়া হয়— এমন অভিযোগ হয়তো অমূলকও নয়। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা কি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই প্রথম ঘটিতেছে? বামফ্রন্ট সরকারের সাড়ে তিন দশকের সভা-পরিচালনার ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যাইবে, সেখানেও বিরোধী পক্ষ যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা পাইত না। শাসক পক্ষের বিপুল গরিষ্ঠতার সামনে ওয়াক-আউটই ছিল বিক্ষুব্ধ বিরোধীদের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের একমাত্র পদ্ধতি। অথচ বিরোধী পক্ষের পরিষদীয় উপস্থিতি, তর্ক-বিতর্ক, মতান্তর গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধীদের গুরুত্ব হ্রাস কেবল সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে নয়, শাসক পক্ষের ঔদ্ধত্য ও ঔদাসীন্যের কারণেও ঘটিয়াছে। দীর্ঘ বাম আমলে রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীরা যে কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করিতে পারেন নাই, তাহার পিছনে বিধায়কদের অসামর্থ্য একমাত্র কারণ ছিল না, সভা-পরিচালনায় তাঁহাদের অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করার অবাঞ্ছিত ঐতিহ্য কায়েমের ভূমিকাও যথেষ্টই ছিল। বামপন্থীরা যাহা শৈল্পিক নৈপুণ্যে করিতেন, তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে তাহা হয়তো কিছুটা স্থূল ভাবে ঘটিতেছে। পুরাতন ঐতিহ্যটিই চলিতেছে। হয়তো আরও পঁচাত্তর বছর চলিবে। |