গোদালা কিরণকুমার এবং কে জয়রামনকে কেন্দ্র করিয়া যে ঘটনাক্রম চলিতেছে, তাহাতে দেশের প্রশাসনিক রীতিনীতি সম্বন্ধে অনতিসচেতন কোনও নাগরিকের মনে একটি প্রশ্ন জাগিতে পারে— ‘আইনের চোখে প্রত্যেকে সমান’, এই কথাটি কি তবে নিছকই গুজব? কথাটি সত্য হইলে কেন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত এক জন আইএএস অফিসারকে গ্রেফতার করিলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে শাস্তি পাইতে হইবে? প্রশ্নটি আন্তরিক হইতে পারে, কিন্তু অজ্ঞানতাপ্রসূত। আইনের চোখে প্রত্যেকে সমান, কিন্তু সেই সাম্যেরও রীতিনীতি আছে। গোদালা কিরণকুমারকে গ্রেফতার করা অসম্ভব নহে। প্রয়োজন পড়িলে তাঁহাকে, অথবা অন্য যে কোনও আমলাকে, গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু সেই এক্তিয়ার কে জয়রামন বা অন্য কোনও আই পি এস অফিসারের নাই। তাহার নির্দিষ্ট পথ আছে। অভিযুক্ত আমলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমেই তাঁহাকে গ্রেফতার করিতে হইবে। আইন আইনের পথেই চলিবে, কিন্তু সেই পথটি পুলিশ কমিশনারেট হইয়া নহে, নবান্ন হইয়া যায়। কে জয়রামন এই রীতিটি বিস্মৃত হইয়াছিলেন। অতিসক্রিয় হইয়া তিনি নিজের হাতে আইন লইয়া ফেলিয়াছিলেন, সাংবিধানিক পদ্ধতি অমান্য করিয়াছিলেন। ফলে, গোদালা কিরণকুমার কতখানি দোষী, অথবা জয়রামন কতখানি ন্যায়ধ্বজ, এই প্রশ্নগুলি অবান্তর। জয়রামন রীতিভঙ্গের দোষে দুষ্ট, এবং তাঁহাকে প্রাপ্য শাস্তি পাইতে হইবে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, যেখানে একই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে কেহ প্রশাসনিক বিভাগে চাকুরি পান আর কেহ পুলিশ বিভাগে, তবে সম্পর্কের এই উচ্চাবচতা কেন? একটিই উত্তর— সাংবিধানিক প্রথা। সেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসিবার সময়েই ছাত্রছাত্রীরা জানেন, রীতির মাপকাঠিতে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের স্থান ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের ঊর্ধ্বে। যে কোনও রাজ্যের পুলিশের মহানির্দেশক সেই রাজ্যের মুখ্যসচিবের পরামর্শ মানিয়া চলেন। জেলার পুলিশ সুপারকে কাজ করিতে হয় জেলাশাসকের পরামর্শে। শুধু পুলিশ নহে, সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। ভারতের সেনাপ্রধান দেশের প্রতিরক্ষা সচিবের কথা মানিয়া চলেন। স্বয়ং জওহরলাল নেহরু খেয়াল করাইয়া দিয়াছিলেন গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক বাহিনী বা পুলিশ বিভাগ কখনও প্রশাসনোর্ধ্ব হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে। প্রতিরক্ষা-ক্ষমতা প্রশ্নাতীত হইলে তাহার ফল কী হইতে পারে, সেই উদাহরণ দেখিতে বেশি দূরে যাইতে হইবে না, গণতন্ত্র কী ভাবে অস্ত্রধারীর অধীন হইয়া অকার্যকর হইয়া পড়ে, তাহার প্রমাণ ভারতের প্রতিবেশী দুনিয়াতেও জাজ্বল্যমান। বস্তুত, উপনিবেশ-উত্তর দুনিয়ায় ভারত একটি বিরল দৃষ্টান্ত যেখানে সামরিক বাহিনী কখনও ছড়ি ঘুরাইতে পারে নাই, সাংবিধানিক শাসনবিভাগ নিরুপদ্রবে কাজ করিতে পারিয়াছে। ইহা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। সমঝোতার একচুল স্থানও এখানে নাই। কেহ বলিতেই পারেন, কে জয়রামনের অপরিণামদর্শিতা একেবারে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে আঘাত করিতে পারে, এমন আশঙ্কা বাড়াবাড়ি। সত্য, এক জয়রামনে অভ্যুত্থান আসে না। কিন্তু, রীতিভঙ্গের পথটি বিপজ্জনক রকম পিচ্ছিল। সেই পথে এক বার যাইলে বারবার না যাইবার কোনও নিশ্চয়তা নাই, ঘুরিয়া দাঁড়াইবারও উপায় নাই। অতএব, প্রশাসনিক রীতিভঙ্গের প্রথম ঘটনাতেই কঠোর পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়। বার্তাটি প্রথম বারেই দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রেরণ করা বাঞ্ছনীয়। তাহাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানটিও নিরাপদ থাকে। তবে একই সঙ্গে অভিযুক্ত আমলার বিরুদ্ধে তদন্তও পূর্ণ গতিতে চালাইয়া যাওয়া বাঞ্ছনীয়। অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ পদ্ধতিতে পদক্ষেপণ প্রয়োজন। কে জয়রামনের শাস্তি যে গোদালা কিরণকুমারকে বাঁচাইবার ফিকির নহে, এই কথাটিও স্পষ্ট হওয়া দরকার। |