পাহাড়ি ঝর্নার পাশে ছিল তাঁর বাড়ি। শৈশব কেটেছে পরিচারকের কাজ করে।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এলভিস অ্যারন সিকিমের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছিলেন। বিয়ে করে সংসারও পেতেছিলেন। কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী ছেড়ে চলে গেলেন। আত্মীয়-পরিজনহীন একা এলভিস চলে যান বেঙ্গালুরু। হোটেল ম্যানেজমেন্টের পাঠ নিয়ে শুরু করেন হোটেল ম্যানেজারের চাকরি।
২০১২ সাল অক্টোবর মাস। বেঙ্গালুরুর হোটেল থেকে দেখতে পান উল্টো দিকে রাস্তার পাশের মোমো-র দোকানে কাজ করছে একটি পাহাড়ি মেয়ে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। এলভিস জানতে পারেন, মেয়েটির নাম ডিকি শেরপা। সে-ও সিকিমের। দু’চার কথার পরেই ঝরঝর করে কান্না। ডিকি-র দু’টি কিডনি-ই বিকল। এলভিস ডিকিকে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। নিজের জমানো টাকা খরচ করে ডায়ালিসিস করালেন। জানতে পারেন, অবিলম্বে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
ডিকি এখন ৩২। কিডনির সমস্যা ২০ বছর বয়স থেকেই। পাঁচ বছর আগে কলকাতায় এসে মায়ের কিডনি নিয়ে ডিকির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ওষুধ খেতে হবে নিয়ম করে। বাগান পরিচর্যার সামান্য কাজ করে দামি ওষুধ কেনার টাকা কোথায় পাবেন! রোজগারের আশায় বেঙ্গালুরু গিয়ে চাকরি শুরু করেছিলেন। কিন্তু তত দিনে মায়ের দেওয়া কিডনিটিও বিকল হয়ে গিয়েছে।
জীবনের এমন একটি বাঁকেই ডিকির সঙ্গে আলাপ হল এলভিসের। এলভিস বললেন, “আমি কিডনি দেব।” কিন্তু দেব বললেই দেওয়া যায় না। চিকিৎসকেরা জানালেন, নিকটাত্মীয় ছাড়া কারও কিডনি নেওয়া মুশকিল। অনেক ঝামেলা। সরকারের অনুমতিরও প্রয়োজন। ডিকির হাত ধরে এলভিস বলেন, “আমি বিয়ে করব তোমাকে।”
|
এলভিস খ্রিস্টান, ডিকি বৌদ্ধ। বাধা ছিল আরও। সে সব পেরিয়ে এ বছরের সেপ্টেম্বরে ডিকিকে বিয়ে করেছেন ২৭ বছরের এলভিস। এলভিস ও ডিকি দু’জনেই এখন কলকাতায়। পাঁচ বছর আগে যিনি ডিকির শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন, সেই চিকিৎসক দীপকশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তাঁরা।
এলভিসের উদ্যোগের প্রশংসা করছেন দীপকবাবু। পাশাপাশি সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই জাতীয় ঘটনা খুব ভাল করে বিচার করে দেখে তবেই এগোনো উচিত। “এমন হতেই পারে কিডনি পাওয়ার জন্য কাউকে বিয়ে করা হল। কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে টাকা দিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে নেওয়া হল।”
এ রকম দৃষ্টান্তও দিচ্ছেন নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার। বছর সাত-আট আগে অন্য রাজ্য থেকে এসে উচ্চবিত্ত এক যুবক কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ভর্তি হন। কিডনি দেওয়ার কথা ছিল তাঁর স্ত্রীর। স্ত্রীকে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল অভিজিৎবাবুর। তিনি মহিলা হাউসস্টাফদের বলেন, যুবতীর সঙ্গে কথা বলতে। “যুবতী স্বীকার করেন, টাকার লোভ দেখিয়ে তাঁকে বিয়ে করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। আমরা সেই প্রতিস্থাপন করিনি।”
এলভিস-ডিকির গল্প অবশ্য তা নয়। দু’জনেই দরিদ্র। কিডনি প্রতিস্থাপনের ছয় লক্ষ টাকা যোগাড় করতেই হিমসিম অবস্থা। এলভিসের কথায়, “বেঙ্গালুরুর ১৫ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। জানি না কোথায় পাব টাকা!”
গত বার ডিকির কিডনি প্রতিস্থাপনের সময়েও খরচ হয়েছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া, কলকাতা পুলিশের তৎকালীন আইজি জুলফিকার হাসান-সহ বেশ কয়েক জন সাহায্য করেছিলেন। সবার দরজায় কড়া নাড়ছেন নবদম্পতি। জুলফিকার এখন দিল্লিতে, সিআরপি-তে। ফোনে বললেন, “চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব সাহায্য করতে। কিন্তু সবটা দেওয়া তো সম্ভব নয়।”
ডিকি কথা বলতে পারছেন না। বুজে আসছে গলা। দু’চোখ বেয়ে জল। তিনি একটাই কথা জানেন। তাঁর আর মৃত্যুর মাঝখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পাহাড়ি ঝর্নার পাশে বেড়ে ওঠা এক যুবক এলভিস! |