|
|
|
|
|
নেট-বাণিজ্যেও বিদেশি
বিনিয়োগে তৎপর কেন্দ্র
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি
৫ ডিসেম্বর |
|
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জিনিসপত্র বেচাকেনা বা ‘ই-কমার্সে’ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিতে চাইছে মনমোহন-সরকার।
চেষ্টা চলছে লোকসভা নির্বাচনের আগেই বিষয়টি সেরে ফেলার। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত সংগ্রহের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রক একটি আলোচনাপত্র তৈরি করছে। তবে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার মতো ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও বিদেশি বিনিয়োগের প্রবল বিরোধিতা শুরু করেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ছোট ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলি।
হরেক রকম ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় ৫১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হলেও কোনও বহুজাতিক সংস্থা এখনও ভারতে লগ্নি করেনি। এ বার তাই ঘুরপথে লগ্নি টানতে ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও বিদেশি সংস্থাগুলিকে ৫১ শতাংশ বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিতে চায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াও এ বিষয়ে একমত। সেপ্টেম্বরে মনমোহনের মার্কিন সফরের অন্যতম মূল আলোচ্য ছিল ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগ। অক্টোবরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের মার্কিন সফরের সময়েও সে দেশের শিল্পপতিরা তাঁকে ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত ২৮ অক্টোবর চিদম্বরমকে চিঠি লেখেন আমেরিকা-ভারত বাণিজ্য পরিষদ (ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিল)-এর প্রেসিডেন্ট রন সমার্স। চিঠিতে তাঁর আবেদন, এমন ভাবে এই ছাড়পত্র দেওয়া হোক, যাতে রাজ্য স্তরে বাধা না আসে। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে পশ্চিমবঙ্গে ওয়ালমার্টকে দোকান খুলতে বাধা দিতে পারেন। কারণ রাজ্যের হাতে নানা রকমের লাইসেন্স দেওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ই-কমার্সের ক্ষেত্রে সেই শিকল চাইছেন না মার্কিন লগ্নিকারীরা। তা ছাড়া, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে শর্ত দেওয়া হয়েছে, অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্য এ দেশের বাজার থেকেই তুলতে হবে। রন সমার্স-রা চাইছেন, ই-কমার্সে যেন এমন কোনও শর্ত যেন চাপানো না হয়।
ঠিক এইখানেই আপত্তি তুলছে দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স’। তাদের যুক্তি, বহুজাতিক সংস্থাগুলি চিন, বাংলাদেশ, ফিলিপিন্স বা তাইওয়ান থেকে সস্তার পণ্য নিয়ে এসে এ দেশে বিক্রি করবে। যেমনটা আমেরিকা বা ইউরোপের বহু
দেশে হয়েছে। কিন্তু এর ফলে ভারতীয়দের ব্যবসাই মার খাবে। কনফেডারেশনের মহাসচিব প্রবীণ খান্ডেলওয়াল বলেন, “কোনও ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ই-কমার্সকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। কেউ অসমে গুদাম খুলে পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করতে পারে। এ বিষয়ে সরকার কোনও রকম পদক্ষেপ করলেই জোরালো বিরোধিতা করব।”
প্রবীণের ব্যাখ্যা, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্থাগুলি বড় আয়তনের সুপারমার্কেট খোলে। তাদের পক্ষে পাড়ায় পাড়ায় দোকান খোলা সম্ভব নয়। কিন্তু ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্থাগুলিকে দোকানও খুলতে হচ্ছে না। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তারা সব জিনিসপত্রই বেচতে পারবে। দরকার শুধু গুদামঘর।
এমনিতে এ দেশে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কেনাকাটা জোরকদমেই চলছে। এমন অনেক সংস্থা এসে পড়েছে, যারা কাজ করে পণ্য ও ক্রেতার মধ্যে ‘প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে। ধরা যাক, ক্রেতা ওই ই-কমার্স সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে কোনও বিশেষ ব্র্যান্ডের ঘড়ি, জুতো বা মোবাইল বেছে নিয়ে অনলাইনে অর্ডার করে দিলেন। এ বার ই-কমার্স সংস্থাটির দায়িত্ব হল, ঠিক সেই জিনিসটি সংশ্লিষ্ট নির্মাতা সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট নির্মাতা সংস্থাই। অবশ্য ভারতীয় ই-কমার্স সংস্থাগুলির দেশ-বিদেশের বাজার থেকে পণ্য কিনে ও মজুত করে তা নিজেদের ঠিক করা দামে বিক্রির ছাড়পত্র রয়েছে। তবে বহুজাতিক সংস্থাগুলির তুলনায় তাদের পুঁজি ও ব্যাপ্তি অনেক কম। ফলে তাদের নিয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের চিন্তা নেই।
মার্কিন ই-কমার্স সংস্থা আমাজন এ দেশে এসেছে বটে, কিন্তু তারা এখনও অনলাইনে অন্য সংস্থার পণ্যই বিক্রি করে। নিজেদের পণ্য বিক্রির ছাড়পত্র তাদের নেই। এ দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হলে আমাজনের মতো সংস্থাগুলি পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে অনায়াসে পণ্য কিনে এনে ভারতে বিক্রি শুরু করবে। এবং এখন যেমন ক্রেতা নির্দিষ্ট করে বলে দেন, তিনি কোন ব্র্যান্ডের কোন জিনিসটি কিনবেন, তখন ই-কমার্স সংস্থাই তাঁর সামনে বিভিন্ন ‘অপশন’ তুলে ধরবে। অর্থাৎ, ওয়েবসাইটে ‘জুতো’ সার্চ দিয়ে কোনও ব্যক্তি হুবহু একই রকমের একটি ভারতীয় এবং একটি চিনা জুতো দেখবেন। দামের দিক থেকে হয়তো চিনা জুতোটি অনেক সস্তা। স্বভাবতই ক্রেতা সাশ্রয়ের পথেই হাঁটবেন।
এই কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ছোট ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলি। তাদের বক্তব্য, যে ভাবে স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে, তাতে ইন্টারনেটে কেনাকাটার প্রবণতা আরো বাড়বে। ই-কমার্স সংস্থাগুলি যত বেশি গুদাম খুলবে, ততই ডেলিভারি-টাইম কমবে। আমাজন তো সম্প্রতি জানিয়েই দিয়েছে, স্বয়ংক্রিয় উড়ন্ত যানের (আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকল)-এর মাধ্যমে আধ ঘণ্টায় বাড়ির দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে তারা।
আমাজনের ডিরেক্টর ও জেনারেল ম্যানেজার (সেলার সার্ভিসেস) অমিত দেশপাণ্ডের বক্তব্য, “আমরা এ দেশে লম্বা দৌড়ে থাকার জন্য এসেছি। আমাদের বিশ্বাস, ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগ এলে ক্রেতারাই লাভবান হবেন। শুধু বেছে নেওয়ার সুবিধে নয়। কম দামে, ভাল মানের পণ্য কেনারও সুযোগ মিলবে।” রন সমার্স তাঁর চিঠিতে যুক্তি দিয়েছেন, ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগ এলে সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিরই লাভ। রাজকোষ ঘাটতি ও বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের ঘাটতি কমবে। গুদাম, সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন লগ্নি হবে, নতুন পরিকাঠামো গড়ে উঠবে। তৈরি হবে কর্মসংস্থান। সরকারেরও কর বাবদ বাড়তি আয় হবে। শুধু অক্টোবরে নয়, এপ্রিলেও রন সমার্স একই বিষয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন চিদম্বরমকে।
বাণিজ্য মন্ত্রকের একটা অংশ অবশ্য এই পথের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। কারণ প্রথমত, ই-কমার্সে জড়িত দেশজ সংস্থাগুলির পায়ের তলার জমি এখনও শক্ত হয়নি। এখনই আমাজন বা চিনের আলিবাবা-র মতো বড় সংস্থাগুলি চলে এলে তারা প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারবে না। দ্বিতীয় চিন্তা এ দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে নিয়ে। এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় ২২ কোটি পরিবার যুক্ত। বাণিজ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “২০১১ সালে ভারতে ই-কমার্সের ব্যবসার পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ডলার। কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে তা ১৭০০ কোটি ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। এই বাজারটাই ধরতে চাইছে বিদেশি সংস্থাগুলি। তবে তাতে সরাসরি কর্মসংস্থান কত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।”
সম্ভাবনা ও সংশয়। মনমোহন কোন পথে এগোন, সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|