শনিবার। এই একটা দিনের দিকে সারা সপ্তাহ চেয়ে থাকেন ওঁরা। সন্ধ্যা হতে না হতেই আর বাড়িতে নয়। কোনও মতে অপিস ফেরত স্বামীর হাতে চা-জলখাবারটুকু এগিয়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়েন ওঁরা। গন্তব্য বিষ্টুপুরের জে রোডের মিলনী ক্লাব। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় সেখানে প্রবাসের বাঙালি গৃহিণীরা জড়ো হন বাংলা গানের আড্ডায়। উদ্দেশ্য মূলত দু’টি। আড্ডা মারতে মারতেই বাংলা গান তথা সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। আর ঘরকন্না, সংসারের চাপে গানের সঙ্গে আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কটা ফের ঝালিয়ে নেওয়া।
দু’এক জন রয়েছেন যাঁরা পেশাগত ভাবেই বাংলা গানের সঙ্গে রয়েছেন। তবে অধিকাংশই অপেশাদার। পেশাদার গায়িকারা অপেশাদার গায়িকাদের সাহায্য করেন গান তুলতে। তারপরে প্রত্যেকেই চেষ্টা করেন সপ্তাহ-ভর গানগুলি নিয়ে অনুশীলন করার। পরের শনিবার সন্ধ্যায় প্রত্যেকেই শোনান আগের সপ্তাহে শেখা গানটি। কখনও গান হয় রবীন্দ্রনাথের। কখনও নজরুল। আবার কখনও অতুলপ্রসাদ। এ ভাবেই জামশেদপুরের প্রবাসী বঙ্গবধূদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে বাংলা গান।
এমনই এক শনিবার সন্ধ্যায় দেখা সোনালী সেনগুপ্ত, তাপসী করঞ্জাই, মৈত্রেয়ী মিত্রদের সঙ্গে। আটাত্তর বছরের মৈত্রেয়ী মিত্র পেশায় চিকিৎসক। শনিবার সন্ধ্যা হলে মিলনীতে তিনি আসবেনই। পায়ের ব্যাথার কারণে মাটিতে বসতে পারেন না। চেয়ারে বসেই গীতবিতান খুলে অন্যদের গানের সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করেন তিনি। তাঁর কথায়, “দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। কিন্তু অন্তরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে রয়েছেন। রয়েছেন নজরুল। ফলে দেশে ফিরে সুযোগ পাওয়া মাত্রই আবার চর্চা শুরু করে দিয়েছি।” তাপসীদেবী অবশ্য গান-বাজনা নিয়েই থাকেন। |
চলছে গানের মহড়া। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী। |
একাধিক সংস্থায় তিনি গান শেখান। তবে মিলনীতে তিনি পেশাদার সঙ্গীত শিক্ষিকা নন। তিনি এই আড্ডা চক্রের অন্যতম সদস্য। তাঁর কথায়, “বিয়ের পরে কলকাতা ছেড়ে চলে আসার কারণেই হোক কিংবা পেশার টানে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা— গানের সঙ্গে অনেকেরই বিচ্ছেদ ঘটেছে দীর্ঘদিন আগে। কিন্তু বাংলা গানের প্রতি ভালোবাসাটা মরেনি। ফলে প্রত্যেকেই ভীষণ উৎসাহ নিয়ে গান তোলেন।” সোনারির বাসিন্দা শর্মিলা পাল জানান, যাঁরা গানটা প্রথাগতভাবে জানেন তাঁরাই প্রথমে সাহায্য করেন। একবার গান উঠে গেলে প্রত্যেকেই সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলি বাড়িতে বসে গানটি ভালো করে প্র্যাকটিস করেন। প্রয়োজনে টেলিফোনেও একে অন্যের সাহায্য নেন। মিলনীর ওই গানের ‘আড্ডা’র জনৈক সদস্যা সোনালী সেনগুপ্তর কথায়, “ছেলে-মেয়েরা বাড়ির বাইরে থাকে। বাড়িতে কাজের পরেও অনেকটা সময় থাকে। বাজে আড্ডা না দিয়ে তাই আমরা চেষ্টা করছি নতুন করে বাংলা গানের সঙ্গে ছেড়ে যাওয়া যোগসূত্রটি জুড়তে। আমাদের লক্ষ্য, বাংলা সংস্কৃতির প্রতি পরের প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা।”
এ ভাবে গান নিয়ে আড্ডা মারতে মারতেই অনেকেই মোটামুটি ফের সঙ্গীত চচার্র মধ্যে ফিরেছেন। ফলে জামশেদপুর তো বটেই, মিলনীর ওই মহিলাদের গানের দল অনুষ্ঠান করতে ডাক পেয়েছেন কলকাতা থেকেও। এমনকী ঝাড়খণ্ড রেডিওতেও তাঁরা অনুষ্ঠান করেছেন। ক্লাবের কর্মকর্তা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “ক্লাবের ফাঁকা হলঘর খুলিয়ে গানের আড্ডা চালু করেছিলেন কয়েক জন গৃহবধূ। তাঁদের দেখাদেখি এখন অন্যান্য মহিলারাও আসছেন। এখন সন্ধ্যার পরে মিলনীর হল ঘর থেকে গান, কবিতা পাঠ শুনতে পাওয়া যায়। ফলে এখন ক্লাবের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের আর বাইরে থেকে শিল্পীদের বেশি ডাকতে হয় না।” |