সে প্রায় দশ-পনেরো বছর আগের কথা। ভদ্রলোক তখন বিজ্ঞাপনের ছবি বানান। কলকাতা-মুম্বই করে বেড়ান নিয়মিত। ইয়াহু চ্যাটরুমে আলাপ হল এক বর্ষীয়ান মহিলার সঙ্গে। পেশায় জ্যোতিষী। ক্রোয়েশিয়ায় থাকেন। প্রায়শই চ্যাটে কথা হত দু’জনের। মেমসাহেব মনের সুখে ভবিষ্যদ্বাণী আউড়ে যেতেন। আর ভদ্রলোক হাঁ করে দেখতেন, ‘এই ক্রোয়েশিয়া!’
দেখার সুযোগ মিলত বটে! কম্পিউটারের স্ক্রিনেই দেখা যেত, মহিলার ঘরে বিরাট বিরাট জানলা। গরাদ নেই, পর্দা নেই। পাশেই রাস্তা। সেখানে লোকজন হাঁটছে, গাড়ি যাচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে সব দেখা যেত কলকাতায় বসে।
“সত্যি ক্রোয়েশিয়া কি না কে জানে! ভদ্রমহিলা বলতেন ক্রোয়েশিয়া!”
নিশ্চিত নন গৌরব পাণ্ডে।
নিশ্চিত হওয়ার উপায়ই বা কী? ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কে কতটা সত্যি বলছে, বোঝা দুষ্কর। অথচ তার দুর্নিবার আকর্ষণকেও ঠেকানো মুশকিল। ভার্চুয়ালের এই মায়াজাল কী করে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, গৌরবের ছবিতে তারই পর্দা উঠবে আজ। বসিরহাট থেকে আইসল্যান্ডে উড়ে যাওয়া এই গল্পের নাম হনুমান ডট কম।
ইন্টারনেটের নেশা, যৌন ফ্যান্টাসি, চ্যাট-বন্ধুত্বের মতো বিষয় বাংলা ছবিতে এই প্রথম এল, এমন নয়। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর অন্তহীন, কিউ-এর গান্ডু, অতনু ঘোষের তখন তেইশের মতো একাধিক জনপ্রিয় ছবিতে এ ধরনের বিষয় দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে ছিল ছবির নানা উপাদানের মধ্যে একটা উপাদান। গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নেট-জীবনের কোনও কোনও দিক ব্যবহার হয়েছিল।
অন্তহীন-এ যেমন নায়ক-নায়িকার মধ্যে চ্যাট-এর মধ্যে দিয়েই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাস্তবেও তাদের দেখা হয়। কিন্তু তখনও দু’জনে জানেই না যে, তারা একে অপরের সঙ্গে এত দিন কথা বলে এসেছে। তখন তেইশ-এ একটি মেয়ের শখ ছিল চ্যাট-এ নানা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো আর তার পর তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। কিউ-এর ছবিতে ইন্টারনেট ছিল যৌন ফ্যান্টাসির উৎস। |
কিন্তু হনুমান ডট কমে ইন্টারনেট নিজেই একটি চরিত্র। আন্তর্জাতিক চরিত্র। সে-ই অনেকটা নিয়তির মতো নিয়ন্ত্রণ করে বাস্তব চরিত্রগুলোর জীবন-মরণ। ছবিতে কম্পিউটারের পোকা বাচ্চা মেয়েটি বুঝিয়ে বলে, কম্পিউটার আসলে একটা বাড়ির মতো। দরজা-জানলা-বারান্দা-আলমারি-তালা-চাবি, সব আছে। এমনকী আস্তাকুঁড়ও আছে। আর, সেই বাড়ি থেকে চাইলে খোলা যায় যত ইচ্ছে জানলা। দেখা যায় যত দূর খুশি।
কিন্তু কী দেখা যায়? যা দেখা যায়, সেটা কতটা বাস্তব আর কতটা নয়? “ভার্চুয়াল মানে কিন্তু ঠিক অবাস্তব নয়। ভার্চুয়াল মানে যাকে ধরাছোঁয়া যায় না।” কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্বামী ভূদেবানন্দ ব্যাখ্যা করে দেন, একটা ওয়েবসাইট তো অবাস্তব নয়। সেটা আছে। কিন্তু যে ভাবে কম্পিউটারে মাউস-মনিটর-সিপিইউ চোখে দেখা যায়, হাতে ধরা যায়, একটা ওয়েবসাইটকে যায় না। সেটা পর্দাতেই দেখতে হয়। কিন্তু ওয়েবসাইটে যা দেখা যায়, সেটা সত্যি তো বটেই।
ঠিক যেমন গৌরব দেখতে পেতেন মেমসাহেবের জানলা। মেমসাহেব ক্রোয়েশিয়ায় না-ও থাকতে পারেন, নিজের যা নাম বলেছেন সেটা ভুয়ো হতে পারে। কিন্তু জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে রাস্তাটা, সেটা সত্যি। কিন্তু এ বার যদি সত্যি করে সেই রাস্তায় পৌঁছে যেতে চায় কেউ? তখনই বাস্তব আর ভার্চুয়ালের টানাপোড়েন শুরু। সেই টানাপোড়েন কাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে, তা কে জানে!
দিব্যি ছাপোষা মানুষ, বাজার থেকে রুইমাছ কিনে বাড়ি ফেরেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হঠাৎ করে পর্নো সাইটের ভাঁড়ারে ঢুকে পড়লে তাঁর কী হবে, কে বলতে পারে? প্রশ্ন ছুড়লেন গৌরব। এ তো শুধু প্রশ্ন নয়, ঘোর বাস্তব। গত এক বছরে গ্রামীণ ভারতেই ইন্টারনেট-সক্রিয়দের সংখ্যা ৫৮% বেড়েছে। কলকাতায় মনোবিদরা লক্ষ করেছেন, গত কয়েক বছরে ইন্টারনেট আসক্তিজনিত সমস্যা বেড়ে গিয়েছে।
মনশ্চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় তেমনই একটা গল্প শোনাচ্ছিলেন মেয়েটির বাবা-মা দু’জনেই ডাক্তার। স্বপ্ন ছিল, জামাইও ডাক্তার হবে। মেয়েটি মরিয়া হয়ে নানা সাইটে ডাক্তারদের প্রোফাইল খুঁজে খুঁজে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাতে শুরু করে। এ ভাবে এক জনের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায় চ্যাটের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু যে দিন মুখোমুখি হওয়ার সময় এল, দেখা গেল লোকটি সর্বৈব ভণ্ড। বয়স্ক বিবাহিত মানুষ, হাতুড়ে প্র্যাকটিস করে। নেট-এ মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোই তার নেশা। মেয়েটি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এ ঘটনার পর।
তবে এ রকম ঘটনা কি আর ইন্টারনেট-যুগের আগে ঘটেনি কখনও? সমাজবিদ প্রশান্ত রায় মনে করতে পারেন, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পত্রবন্ধুত্ব করার ফ্যাশন প্রবল হয়েছিল। তখনও ভুল নাম-ঠিকানা দিয়ে চিঠি লেখার প্রবণতা ছিল। কিন্তু সেই অভিঘাত আর ইন্টারনেটের অভিঘাতে আকাশ-পাতাল তফাৎ। প্রশান্তবাবুর কথায়, স্বাধীনতার উত্তুঙ্গ আকর্ষণ আর সেই স্বাধীনতার নিজস্ব ফাঁদই ইন্টারনেট প্রজন্মের কাছে বড় দোটানার বিষয়।
এই দোটানাই এক রকম ভাবে বর্তেছে হনুমান ডট কমের অঞ্জনিপুত্রের উপর। ভাল মানুষ স্কুলশিক্ষকটির জীবনের গতিপথটাই পাল্টে দিয়েছে। মাথায় হনুমান টুপি পরা, শৈশবে নিজের মাস্টারমশাইয়ের আদলই চরিত্রটার মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন প্রসেনজিৎ। এ ছবিতে তিনি তারকা প্রসেনজিৎ নন কোনও ভাবেই। তারকার আকর্ষণ বা স্টারডম ব্যাপারটাও যে পুরোপুরি ভার্চুয়াল, সেটা বারবারই মনে হয়েছে তাঁর। মানুষ তারকাকে চেনে সিনেমায় দেখে আর কাগজে পড়ে। তাই দিয়ে তৈরি হয় প্রতিমা। বাস্তবের মানুষটার সঙ্গে তার মিল কতটুকু? অথচ সেই প্রতিমাটাই আট থেকে আশির কাছে তারকার পরিচয়। “এই যে সবাই বুম্বাদা বলে ডাকে, এটাও তো ভার্চুয়াল পরিচয়, তাই না?”
ইন্টারনেট আলাপের মতোই ভার্চুয়াল। তারকার নামটাই আইডি। সেটাই পাসওয়ার্ড। |