এক সময় শ্যালো, সাবমার্সিবল পাম্প তথা ক্ষুদ্র সেচের কোনও সুযোগ ছিল না। মূলত বৃষ্টির জলের উপরেই নির্ভর করতে হত ময়ূরেশ্বর থানা এলাকার চাষিদের। বর্ষায় ধান চাষের পরে অনাবাদী হয়ে পড়ে থাকত বিঘার পর বিঘা জমি। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষিজীবী মানুষজন ‘ডাউকি-দাদপুর জল সরবরাহ’ প্রকল্প নামে একটি সেচ খাল কাটেন। পরে ওই খালটি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু সেই সরকারি সহযোগিতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী এই সেচপ্রকল্প বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সমস্যায় পড়েছেন চাষিরাও। অভিযোগ, বার বার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও খালটি সংস্কারের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। খালটি সংস্কার করা হলে কয়েক হাজার কৃষিজীবী পরিবার উপকৃত হবে, সে কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের একাংশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জল সমস্যা মেটাতে ‘ডাউকি-দাদপুর জল সরবরাহ’ প্রকল্প নামে ওই সেচখাল কাটার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন গোপীদাস বাবাজি নামে এক বৈষ্ণব। ওই সময় নদী বাঁধ এবং সেচ সম্পর্কিত স্বরচিত গান বেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষদের উদ্বুগ্ধ করেন তিনি। তাঁরই অনুপ্রেরণায় এবং ততকালীন স্থানীয় জমিদার নবীনচন্দ্র দুবে ও বিশিষ্ট আইনজীবী হেমচন্দ্র রায়ের পৃষ্টপোষকতায় স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষজন এলাকার ঘোড়দহ বাঁক সংলগ্ন ময়ূরাক্ষ্মী নদী থেকে মুর্শিদাবাদের শুকুরিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সেচখাল মাত্র এক বছরে স্বেচ্ছাশ্রমে কাটেন। সেচের প্রয়োজনে সেই জল ধরে রেখে সময় মতো বণ্টনের জন্য স্থানীয় দাদপুরে নির্মিত হয় একটি কপাট বাঁধও। |
ওই জল সরবরাহ সমিতির চেয়ারম্যান তথা পৃষ্টপোষক জমিদারের বর্তমান বংশধর নির্মলচন্দ্র দুবে জানান, বীরভূম জেলার দাদপুর, বাসুদেবপুর, রসুলপুর থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা থানার মাজিয়ারা, রায়হাট, রানানগর-সহ দেড় শতাধিক গ্রামে সারা বছর ওই সেচ প্রকল্প থেকে জল সরবরাহ করা হয়। সেই প্রকল্পের পরিকল্পনায় এমন সরকারি সেচ খালের জল এলেই তা বিভিন্ন মাঠ এবং সেচ খাল বাহিত হয়ে এই সেচ প্রকল্পে পড়ে রে ফলে চাষিরা ময়ূরাক্ষী নদীর পাশাপাশি সেচ সরকারী সেচ খালের জলও চাষের কাজে লাগানোর সুযোগ পান। এ বাবদ চাষিদের সেচ কর দিতে হয় খুবই কম।
১৯২৪ সালে ‘ডাউকি-দাদপুর’ সমবায় জল সরবরাহ সমিতির অধীনে ওই সেচ প্রকল্পটি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। দাদপুর জলাধারের প্রধান কপাট বাঁধ-সহ সেচ খালের কয়েকটি জায়গায় শাখা কপাট বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারি সাহায্য মিলেছে। একশো দিন কাজের প্রকল্পে বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও ওই প্রকল্পের সেচ খাল সংস্কার হলেও তা চাষিদের কোন কাজেই আসেনি বলে ক্ষোভ। চাষিদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে শাসকদলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে ওই সেচ খালের জমি মৌখিক ভাবে খাস দেখিয়ে পাট্টা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও’বা বেআইনি ভাবে দোকানপাট গজিয়ে উঠেছে। যার ফলে ওই সেচ খালটির জলধারণ এবং জলবহন ক্ষমতা ক্রমেই কমে আসছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বন্ধ হয়ে গিয়েছে ঘোড়দহ বাঁক সংলগ্ন ময়ূরাক্ষ্মী নদীর প্রধান কপাট বাঁধটিও। ফলে নদী থেকে এই সেচ প্রকল্পের জল আশা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে শুধুমাত্র বিভিন্ন সেচ খাল প্লাবিত মাঠ ভাসা জল এখন ওই সেচ প্রকল্পের জলের এক মাত্র উৎস।
ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামের বংশী মণ্ডল, রসুলপুরের অক্ষয় ঘোষ, মুর্শিদাবাদের মাজিয়ারার জীতেন ঘোষ, শুকুরিয়ার শ্রীধর মণ্ডলরা বলেন, “ডিজেল এবং বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধির সময়ে এই সেচ প্রকল্পটি আমাদের কাছে বিরাট ভরসার। কিন্তু সংস্কারের অভাবে ওই ভরসা হারিয়ে যেতে বসেছে।” তাঁদের দাবি, “ওই সেচখাল সম্পূর্ণ সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট বাঁধ নির্মাণ করা হলে বছরে ৮-৯ মাস প্রায় ৫০-৬০ হাজার একর জমিতে সেচের জল মিলত। কিন্তু প্রশাসনের উদাসীনতায় আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি।” হতাশ হয়ে পড়েছেন ওই জল সরবরাহ সমিতির পিওন সুকুমার দাস, হিসাবরক্ষক ধীরেন্দ্রনাথ সুত্রধর এবং কর্মী প্রসাদ গড়াইরাও। তাঁদের কথায়, “দীর্ঘ দিন ধরে আমরা এই সমিতিতে কাজ করছি। চাষিদের দেওয়া জল করের উপরেই নির্ভর করে আমরা বেতন পাই। আশা করেছিলাম সরকার এগিয়ে আসবে।”
ওই জল সরবরাহ সমিতির সম্পাদক তথা স্থানীয় ঢেকা পঞ্চায়তের প্রাক্তন প্রধান, সিপিএমের মানিকচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “সরকার একটু উদ্যোগী হলেই এলাকায় সেচ ব্যাবস্থার এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।” সহমত পোষণ করে ময়ূরেশ্বর ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, তৃণমূলের কল্যাণী দাস বলেন, “ওই সেচ প্রকল্পটি এলাকার চাষিদের খুব উপকারে লাগে। তাই ওই প্রকল্পের উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।” জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছেন, “ওই জল সরবরাহ প্রকল্পটির ব্যাপারে জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট জন প্রতিনিধির কাছে সবিস্তারে খোঁজ নিয়ে আমি নিজে গিয়ে দেখে আসব। তার পরে গুরুত্ব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেব।”
|