আগামী মাসে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। সেই সঙ্গে টানা ঘেরাও আর বিক্ষোভ করে ‘প্রস্তুতি’ শুরু করেছে ডান-বাম সব ছাত্র সংগঠনগুলিই। অভিযোগ, এর জেরে যেমন বিভিন্ন কলেজের পঠনপাঠন বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনিই চাপ আসছে অধ্যক্ষদের উপরেও। তিন দিন ধরে কয়েক দফায় টানা ঘেরাওয়ের জেরে জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ।
বুধবার কলেজের অধ্যক্ষ ধীরাজ বসাককে শহরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। নার্সিংহোম সূত্রে জানা গিয়েছে, অধ্যক্ষের রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিক হারও কমে গিয়েছে। ওই ঘটনায় অভিযোগের তির ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, কলেজের পঠন-পাঠন-সহ বিভিন্ন দাবিতে ছাত্র পরিষদের দখলে থাকা ছাত্র সংসদ এবং দু’জন কর্মী নিয়োগ ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ছাত্র পরিষদেরই এক নেতার নেতৃত্বে একাংশ অস্থায়ী কর্মী একযোগে আন্দোলন শুরু করে।
গত ৩০ নভেম্বর কলেজের পরিচালন সমিতির বৈঠক চলাকালীন, সভাঘরে ঢুকে বৈঠক ভেস্তে দেওয়া এবং অধ্যক্ষকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্র পরিষদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গত মঙ্গলবার সকালেও অধ্যক্ষকে ‘হেনস্থা’ করার অভিযোগ ওঠে ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষকে ঘরেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। অধ্যক্ষের ঘরের দরজায় লাগিয়ে রাখা ছাত্র পরিষদের ব্যানার সরিয়ে বিকেলে অধ্যক্ষ ঘরে ঢুকলেও, কেন ব্যানার সরানো হয়েছে তার প্রতিবাদে ফের বিকেল থেকে ঘেরাও শুরু করে ছাত্র পরিষদ। রাত পর্যন্ত ঘেরাও চলে বলে জানা গিয়েছে। পুলিশের হস্তক্ষেপে ঘেরাও ওঠে। টানা ঘেরাও থেকে ‘বিরক্ত’ অধ্যক্ষ গত মঙ্গলবারই জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। রাতে বাড়ি ফিরে অধ্যক্ষ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন বলে অভিযোগ। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, “অধ্যক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়েছে। কাজে বাধা দেওয়া ও হেনস্থা করার অভিযোগ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজও জোগাড় করা হয়েছে।”
লিখিত অভিযোগে অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পরে ২০০ দিনের মধ্যে আন্দোলনের জেরে ১০০ দিনই কলেজে কাজ পরিচালনা করতে পারেননি বলেন। তিনি নিরাপত্তার অভাবে ভোগার কথাও জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার কলেজের শিক্ষক ছাত্র এবং কর্মীদের নিয়ে সভা ডেকেছেন পরিচালন সমিতির সভাপতি আনন্দগোপাল ঘোষ।
বছর দু’য়েক ছাত্র পরিষদ-ই ছাত্র সংসদের দখল রাখে। গত বছরের মাঝামাঝি ছাত্র পরিষদের একাংশ নেতা-কর্মীরা তৃণমূল যোগ দেয়। তারপর থেকেই কলেজে দুই সংগঠনের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে। বস্তুত ছাত্র পরিষদে ভাঙনের পরে আগামী মাসেই প্রথম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সে কারণেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে থাকা এবং কলেজ প্রশাসনের উপর চাপ তৈরির লক্ষ্যেই বিভিন্ন দাবিতে ঘেরাও আন্দোলন শুরু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, ছাত্র পরিষদের তরফে আবার শাসক দল তৃণমূল প্রভাব খাটিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে দিয়ে ইচ্ছেকৃত ভাবে ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কলেজের ছাত্র সংসদের ছাত্রপরিষদের সহকারী সম্পাদক ভাস্কর নন্দী বলেন, “অধ্যক্ষ নিয়মিত কলেজে আসেন না, গৃহশিক্ষকতা করেন। কলেজের পঠন-পাঠন ঠিক ভাবে পরিচালিত হয় না, এই দাবিতে আন্দোলন করেছি। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন হয়েছে। অধ্যক্ষ অসুস্থ হয়ে পড়ার মতো কোনও আচরণ করা হয়নি।” অন্যদিকে, অস্থায়ী কর্মীরা আন্দোলনের পাশাপাশি অনশনও শুরু করেছেন। কর্মীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কলেজেরই অস্থায়ী কর্মী তথা ছাত্র পরিষদ নেতা শৌভিক চৌধুরী বলেন, “কলেজে দুই কর্মীকে অবৈধ ভাবে নিয়োগ করার অভিযোগ পেয়েছি। তার প্রতিবাদেই আন্দোলন করছি।”
একই ভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে কোচবিহারেও। অনিয়মিত উপস্থিতি ও আর্থিক নয়ছয়ের একাধিক অভিযোগ তুলে এবিএন শীল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। আগামী মাসে ওই কলেজেও নির্বাচন হওয়ার কথা। এ দিন দুপুর দেড়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ঘেরাও চলে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অভিযোগ, গত বছর কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারক পত্রিকা প্রকাশের জন্য ১ লক্ষ টাকা খরচ ধরা হলেও, পত্রিকা এখনও প্রকাশিত হয়নি। আন্দোলনকারীদের তরফে টিএমসিপি নেতা তথা কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক বিমান চৌধুরী বলেন, “ছাত্র ছাত্রীদের স্বার্থেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অনিয়মিত হাজিরা, একাধিক আর্থিক নয়ছয়ের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামতে হয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনের সঙ্গে এ দিনের আন্দোলনের যোগ নেই।” কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “নিয়ম মেনে দায়িত্ব হস্তান্তর করেই কাজের প্রয়োজনে কলকাতা যেতে হয়। সুযোগ পেলে ক্লাসও নিয়ে থাকি। স্মারক পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে।” প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র পরিষদের দখলে থাকা ওই কলেজের ছাত্র সংসদ নেতৃত্ব সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দেন।
টানা আন্দোলন চলছে আলিপুরদুয়ার কলেজেও। ক্যান্টিন সহ গবেষণাগারের পরিকাঠামো উন্নতির দাবিতে গত সপ্তাহ থেকে টানা আন্দোলন চালাচ্ছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। একই দাবিতে গত শুক্রবার কলেজ অবরোধ করে ছাত্র পরিষদ। অবরোধের জেরে ওই দিন কলেজে পঠন-পাঠন বন্ধ ছিল। |