বেলগাছিয়া সেন্ট্রাল ডেয়ারিতে দৈনিক দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা অন্তত ২ লক্ষ লিটার। মান্ধাতার আমলের মেশিন আর কাঁচা দুধের অভাবে উৎপাদন হয় গড়ে ৩৪ হাজার লিটার! ফলে রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের অধীন এই ডেয়ারির প্রায় ১৪০০ কর্মীর একটা বড় অংশ বেতন পান কার্যত কোনও কাজ না করেই।
রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থাগুলির কথা ধরা যাক। পরিবহণ দফতরের প্রাথমিক হিসেব বলছে, ট্রাম-সহ রাজ্যের পাঁচটি পরিবহণ সংস্থায় অন্তত ২০০০ কর্মীর প্রায় কোনও কাজ নেই। এক সময় সরকারি বাস পিছু কর্মীর সংখ্যা ধরা হত ২৪ জন। এখন তা কমে হয়েছে ১০-১২ জন। এটাও যথেষ্ট বেশি বলেই মনে করছেন পরিবহণ কর্তারা।
এগুলি খণ্ডচিত্র। নবান্নের কর্তাদের মতে, সরকারি ও আধা-সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কর্মহীন বেতনভোগী কর্মীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। কাজ না থাকলেও স্থায়ী চাকরি বলে এঁদের বরখাস্ত করা যাবে না। কিন্তু কাজ না দিয়ে শুধু মাইনে দেওয়ার ব্যবস্থায় এ বার এই দাঁড়ি টানতে চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
নবান্ন সূত্রের খবর, গত মঙ্গলবার মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের জারি করা এক নির্দেশে বলা হয়েছে, রাজ্যের সব সরকারি দফতর, তাদের অধীনস্থ অফিস ও সরকার পরিচালিত সংস্থায় উদ্বৃত্ত কর্মীদের চিহ্নিত করা হবে। তার পর তাঁদের অন্যত্র কাজে লাগানো হবে। তাঁদেরই উদ্বৃত্ত কর্মী বলা হবে, যাঁদের হাতে যথেষ্ট কাজ নেই। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সচিব পর্যায়ে ৬ সদস্যের কমিটি গড়া হয়েছে। কমিটিকে ছ’মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দিতে হবে। আজ, বৃহস্পতিবার কমিটির প্রথম বৈঠক।
প্রশাসনের হিসেব বলছে, বর্তমানে রাজ্য সরকারি কর্মী সাড়ে তিন লক্ষ। রাজ্যের অধিগৃহীত ৫১টি সংস্থায় রয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার কর্মী। এই সংস্থাগুলির বেশির ভাগই রুগ্ণ বা উৎপাদন বন্ধ। এদের ঋণ শোধ ও ভর্তুকি মেটাতে বছরে ৩৮৫.২৫ কোটি টাকা খরচ হয় সরকারের। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার কর্মীর মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে কর্মহীনদের চিহ্নিত করে তাঁদের অন্যত্র কাজে বহাল করার সুপারিশ করবে কমিটি। রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মিবর্গ দফতরের এক কর্তা জানান, পুরসভা, পঞ্চায়েতের কর্মী এবং শিক্ষকদের এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
সরকারের কত কর্মী উদ্বৃত্ত? কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, সরকারের কোনও দফতরেই উদ্বৃত্ত কর্মী নেই। যদিও প্রশাসনের কর্তাদের প্রাথমিক অনুমান, উদ্বৃত্ত কর্মীর সংখ্যাটা ৩০%-এর কাছাকাছি। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শূন্যপদগুলিতে এঁদের কাজে লাগানোই লক্ষ্য সরকারের। এতে শূন্যপদ যেমন কমবে, তেমনই বেতন বাবদ একই খরচে বেশি কাজ পাবে সরকার। তবে কাজটা যে যথেষ্ট কঠিন, তা মানছেন প্রশাসনের কর্তারা।
প্রশাসনের উপরের স্তরের শূন্য পদগুলির জন্য অবশ্য কেন্দ্রের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হবে রাজ্যকে। রাজ্যে আইএএস অফিসার থাকার কথা ৩৫৯ জন। রয়েছেন ২১৭ জন। ডব্লিউবিসিএস অফিসার থাকার কথা ১,৭৬৭ জন। আছেন ১৬০০ জন। শূন্য পদগুলি পূরণে দিল্লিতে বারবার দরবার করেও ফল পায়নি রাজ্য।
বাম আমলেও এক বার প্রতিটি দফতরকে তাদের কর্মীর সংখ্যা জানিয়ে উদ্বৃত্তদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তার পর আর উদ্যোগটা এগোয়নি। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি ২০০৮-০৯ সালের উদ্বৃত্ত কর্মীদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি। বাম জমানার এক শীর্ষ কর্তা এর তিনটি যুক্তি দিয়েছেন। এক, ত্রাণ দফতরের কর্মীকে দমকলে দিলে তাঁর দক্ষতাকে ব্যবহার করা সম্ভব নয় সব ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স হয়ে যাওয়া কর্মীকে জেলায় পাঠালে, তিনি মুশকিলে পড়েন, ভাল কাজও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া যতটা উদ্বৃত্ত বলে ধারণা করা হয়, আসল সংখ্যাটা অনেক সময়ই তার চেয়ে কম হয়। প্রশাসনের কর্তারা যদিও বলছেন, মূলত বাম কর্মী ইউনিয়নের দাপটে এই ধরনের সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া যায়নি সে আমলে। এখন শাসক দলের কর্মী ইউনিয়নের সেই দাপট নেই। তবে ভোটের কথা মাথায় রেখে শেষ পর্যন্ত কতটা এগোনো যাবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই প্রশাসনে। বিক্ষিপ্ত ভাবে অবশ্য এই কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। যেমন, কৃষ্ণনগর ডেয়ারি ও বর্ধমান ডেয়ারি এক সময় রাজ্য সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল। উৎপাদন কমে দু’টি ডেয়ারিই কার্যত বন্ধ হয়ে এলে তাদের পরিচালন ভার যথাক্রমে কিষান মিল্ক ইউনিয়ন ও মাদার ডেয়ারিকে দেওয়া হয়। বর্ধমান ডেয়ারির ১৮ জন মাদার ডেয়ারির অধীনে কাজ শুরু করেন। তাঁরা বেতন ও অন্য সুযোগসুবিধা সরকারের কাছ থেকেই পাচ্ছেন। কিষান মিল্ক ইউনিয়ন পরিচালিত কৃষ্ণনগর ডেয়ারিতেও একই শর্তে কাজ করছেন আগের সংস্থার কয়েক জন কর্মী। অনেক সরকারি কর্তার মতে, এটা বসে থাকা কর্মীদের অন্যত্র কাজে লাগানোরই উদাহরণ। |