প্রবন্ধ ২...
মানবাধিকার আন্দোলন রাজনীতিতে আসুক
লোকসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই হিমাংশু কুমারের কথাগুলি নতুন করে মনে পড়ল। কয়েক মাস আগে একটি সাক্ষাৎকারে (‘চেষ্টা করছি মধ্যবিত্ত সমাজকে...’, আ বা প, ২-৮) মানবাধিকার কর্মী গাঁধীবাদী হিমাংশু কুমার বলেছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু মানুষ বিচ্ছিন্ন ভাবে যে সব লড়াই লড়ছেন, সেগুলির সমন্বয় ঘটাতে না পারলে দেশে মানবাধিকার আন্দোলন জোরদার হবে না।
ভোটকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ আখ্যা দেওয়া হলেও, এত বড় একটা দেশের সরকারি ক্ষমতা পাওয়া যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই যে কতটা লোভনীয়, তা নিরক্ষর ভোটদাতার বুঝতে অসুবিধে নেই। আপাতভাবে ডান এবং বাম দলগুলির মধ্যে নীতিগত কিছু ফারাক নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পদ্ধতিগত কোনও মৌলিক ফারাক নেই। সমান হিংস্রতা নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষ অবতীর্ণ হয়। মানুষ তার অসহায় ফলভোগী। কোন সমস্যাগুলিকে তাঁরা প্রাধান্য দেবেন, এমনকী তাঁদের সমস্যাগুলি ঠিক কী, সেটাও ঠিক করে রাজনৈতিক দল। এ এক অদ্ভুত সংকট। জনগণ ভোট দেন, না দিলে কোনও রাজনৈতিক দলই ক্ষমতা পায় না। সেই রাজনৈতিক দলই আবার স্থির করে জনগণ কোন কোন সমস্যা নিয়ে ভাববেন বা ভাববেন না।
তার পর? বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। কলকাতা, ১০ ডিসেম্বর, ’১২। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
মহারাষ্ট্রের গোরাই-মানোরি অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছর সামুদ্রিক ঝড়ের তাণ্ডবে সাধারণ মানুষকে নাকাল হতে হয়। বিশেষ করে ওই অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের দুর্দশা ভোগ করতে হয়। সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে অঞ্চলের পুরনো মানুষ গণেশ ভুসকুটে আমায় বলেছিলেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে কী ভাবে বিপুল পরিমাণ ম্যানগ্রোভ অর্থাৎ বাদাবন ধ্বংস করে নগরায়ণ হয়েছে এবং তার পর থেকেই জলোচ্ছ্বাসের কারণে কেমন ভাবে ভুগতে হচ্ছে। আক্ষেপ করছিলেন যে, যত বারই গ্রামবাসীরা এই বিষয় নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেছেন, তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্বই দিতে চাননি। তাঁরা গুরুত্ব দেন না বলে প্রশাসনও তৎপর হয় না। বস্তুত, গোটা ভারত জুড়েই এই সমস্যা। এমনকী স্থানীয় পঞ্চায়েত স্তরেও যথাযথ পথে সমস্যার মীমাংসা করা যায় না, কারণ সেখানেও মূল বিষয়গুলি স্থির হয় রাজনৈতিক দলের স্বার্থ হিসেব করে। এবং সেই সব খাতেই টাকা দেওয়া হয়, যেগুলি সেই স্বার্থ চরিতার্থ করে। নগরায়ণের সঙ্গে জড়িত ‘অর্থ’ এবং ‘লবি’ এতটাই শক্তিশালী যে, সেখানে নাগরিকের জীবনে সামুদ্রিক ঝড় কতখানি সমস্যা তৈরি করছে তা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না প্রশাসন। বড় জোর ত্রাণের কিছু ব্যবস্থা করা যায়। এই রাজনীতির কোনও অতীত বা ভবিষ্যৎ নেই, সবটাই বর্তমান। জনগণের হাহাকার বা চিৎকার, কোনওটাই শুনতে পায় না সে। আজকের ভারতের রাজনীতিতে এই বধিরতা গণতন্ত্রের আবশ্যিক অংশ হয়ে উঠেছে। তা হলে কি মূলধারার রাজনীতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে না পারলে রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রিক সিদ্ধান্তে কোনও রকম ছাপ ফেলা যাবে না? তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো কি অসম্ভব হয়েই থাকবে? সরাসরি দলীয় রাজনীতির অঙ্গ হয়ে না উঠলে মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন তা হলে কি কেবলই এক একটি দাবি আদায় বা আইন তৈরির আন্দোলন হয়েই থাকবে?
বিনায়ক সেনকে এই প্রশ্নটা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিকই। সোনি সোরির ঘটনাটি সংসদে তোলার জন্য প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে বলা হয়েছিল, কিন্তু সি পি এম, সি পি আই ছাড়া কেউ তোলেনি। আবার এটাও ঠিক, মানবাধিকার আন্দোলনের বহু দিনের দাবি নাগরিকের ‘খাদ্য সুরক্ষা’, সেই দাবি ভারত সরকার মানতে বাধ্য হয়েছে।’
সরকার যদি না মানে? দেশের রাজ্যে রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন আছে। নাগরিকের অধিকার আছে তার কাছে সুবিচার চাইবার। কিন্তু বিশেষত পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে জানি, সরকার যদি মানবিক হওয়ার দায় স্বীকার না করে, তা হলে মানবাধিকার কমিশন নৈবেদ্যের বাতাসার বেশি কিছু হয় না। তখন তার নির্দেশ মানতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য আবার সেই আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। এমনও হতে পারে যে, সরকার কোনও একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ উদ্দেশ্যে, বিশেষ ক্ষেত্রে মানবাধিকারকে মর্যাদা দিল, কিন্তু সেটা সাময়িক কৌশলমাত্র। মনে পড়ে, ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে বামফ্রন্ট সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়েছিল। তার পিছনে যে রাজনীতি ছিল, তা আসলে রাষ্ট্রের মানবিক মুখ ফুটিয়ে তোলার রাজনীতি। জনসাধারণের আস্থা অর্জনের জন্য সাময়িক একটা চাল। কিছু কাল পরেই মরিচঝাঁপিতে সেই বামফ্রন্টের দাঁতনখ বেরিয়ে পড়ে। খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নটিও যে আইনসিদ্ধতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এ কথা কি বলা যায়? আইন হওয়া একটা বড় সাফল্য, কিন্তু শেষ সাফল্য নয়। একটা ধাপ মাত্র। আর নিজের আইন নিজেই লঙ্ঘন করছে, ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে সেটা নতুন কোনও কাজ নয়।
এমনকী, ছত্তীসগঢ়ে, যেখানে প্রতিদিন মানুষের জীবন ও জীবিকার অধিকারকে রাষ্ট্রের বুটের তলায় নিষ্পেষণ করা হচ্ছে, সেখানেও আজও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন নির্বাচনের মূল বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমরা দেখলাম, শুনলাম, গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কোথাও শর্মিলা নেই, মনোরমা বা সোনি নেই, এমনকী অঙ্কিত গর্গের প্রসঙ্গও নেই। যে পুলিশ অফিসার অঙ্কিত গর্গের বিরুদ্ধে সোনির যৌনাঙ্গে পাথর ঢুকিয়ে অত্যাচারের অভিযোগ, তিনি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে তাঁর ‘কর্মনিষ্ঠা’র পুরস্কার পেয়েছেন, নির্বাচনী রাজনীতি তাঁর নামও উচ্চারণ করে না। কাশ্মীরে, উত্তর-পূর্বে, গুজরাত বা মহারাষ্ট্র কিংবা মধ্যপ্রদেশ— যেখানে দলিত, আদিবাসী বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ আছেন, সেখানেই রাষ্ট্র খাঁড়া-হাতে উপস্থিত জানান দিয়েছে। শর্মিলার আমরণ অনশনও তাকে টলাতে পারেনি। মূলধারার দলীয় রাজনীতি মানবাধিকারের দাবিতে কান দেয়নি। বধির এই ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাকেই কি তা হলে চিরসত্য বলে মেনে নিতে হবে?
মূলধারার রাজনীতিতে কেবল ‘ইন্ডিয়া’রই জয়গান। আর রাজনৈতিক দলগুলির বানানো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হইচই। কোথাও ‘ভারত’ নেই, নেই তার প্রতিনিধিত্ব। কিন্তু প্রতিদিন নদী ছিনতাই থেকে শুরু করে আদিবাসী ও দলিত মেয়েদের ধর্ষণ, আগ্রাসী বহুজাতিকের জমি-ক্ষুধা— এ সব থেকে যদি রক্ষা পেতে হয়, তা হলে তো কোনও না কোনও ভাবে মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু কেমন করে সে নেবে এই দায়িত্ব? কেবল বাইরে থেকে আন্দোলন করে? ‘অনশন’ আর ‘জেল ভরো’ করে? না কি, তাকেও যুক্ত হতে হবে এই প্রক্রিয়ায়? প্রশ্নটা নাছোড়বান্দা।
এ প্রশ্নের জবাবে হিমাংশু কুমার বলেছিলেন, এখনও ততটা প্রস্তুত নয় মানবাধিকার আন্দোলন। আর বিনায়ক সেন বলেছিলেন, এই প্রশ্নটি নিয়ে আরও ভাবতে হবে। পরিবেশ রক্ষার যে কোনও প্রসঙ্গ যে মূলত মানবাধিকার রক্ষারই প্রশ্ন, তা তিনি মানেন। কিন্তু মানবাধিকার আন্দোলনকে যদি রাজনীতির মূল ধারায় লড়াইয়ে নামতে হয়, সেটা ঠিক কেমন ভাবে সম্ভব হবে, তা তিনি এখনও ভেবে উঠতে পারেননি।
ভাবনাটা জরুরি বলেই মনে হয়। মূলধারার রাজনীতি এবং নির্বাচনের অন্যতম মূল বিষয় যদি মানবাধিকার রক্ষা না হয়, তা হলে কখনওই সংবিধানের আওতার বাইরে থাকা মানুষের সমস্যা ভারতের সমস্যা হয়ে উঠবে না। আজকের মানবাধিকার আন্দোলনকে এ কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এখনও পর্যন্ত এই আন্দোলন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারেনি। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে, যে ভাবেই হোক দলীয় রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমে শক্তির পরীক্ষা দিতে হবে। আর কোনও গণতান্ত্রিক উপায় আছে বলে মনে হয় না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.