জয়ন্ত ঘোষালের ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এত ভীরু কেন’ (২৮-১১) প্রবন্ধটিতে ভাবার কথা অনেক আছে, কিন্তু গোড়াতেই ভুল। প্রবন্ধের শিরোনাম আসলে হওয়া উচিত ছিল: ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’বাদীরা এত ভণ্ড কেন? ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের দু’পাশে কোটেশন চিহ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভারতের রাজনীতিতে এর চেয়ে বেশি বিকৃত অর্থ আর কোনও শব্দের করা হয়নি। এবং এই বিকৃতি ও ভণ্ডামির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ব্যবহৃত শিরোনামের প্রশ্নের উত্তর: ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’বাদীরা ভীরু, কারণ, তারা ভণ্ড। ভণ্ড কখনও সাহসী হতে পারে না।
লেখক লিখেছেন, ‘বামপন্থীরা অনেকেই মনে করেন, ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান নেহরুবাদী আধুনিকীকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মডেলের ব্যর্থতাটাকে সূচিত করে’। হক কথা। কারণ, ভারতবাসীর প্রধানত হিন্দুর যে কোনও কিছু বোঝার মূল বাহনই হল ধর্ম। এই কথাটা বুঝেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ সাত বছর ধরে পায়ে হেঁটে ভারত ঘুরে। বোঝেননি নেহরু, হ্যারো আর কেমব্রিজ পড়ে। স্বামীজি লিখেছেন, “প্রত্যেক জাতিরই উদ্দেশ্য সাধনের কার্যপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন... আমাদের পক্ষে ধর্মের মধ্য দিয়া ছাড়া কাজ করিবার অন্য উপায় নাই... হিন্দু, রাজনীতি, সমাজ সংস্কার ও অন্যান্য যাহা কিছু সবই ধর্মের ভিতর দিয়া ছাড়া বুঝিতে পারে না। জাতীয় জীবন-সঙ্গীতের এইটিই যেন প্রধান সুর, অন্যগুলি যেন তাহারই একটু বৈচিত্র্য মাত্র। আর এটিই নষ্ট হবার আশঙ্কা হইয়াছিল... যে মেরুদণ্ডের বলে আমরা দণ্ডায়মান, আমরা যেন তাহার পরিবর্তে অপর একটি মেরুদণ্ড স্থাপন করিতে যাইতেছিলাম, আমাদের জাতীয় জীবনের ধর্মরূপ মেরুদণ্ডের স্থানে আমার রাজনীতিরূপ মেরুদণ্ড স্থাপন করিতে যাইতেছিলাম।” (স্বামী বিবেকানন্দ, ‘জাগো যুবশক্তি’ উদ্বোধন কার্যালয় ১৯তম পুনর্র্মুদ্রণ, পৃ: ৯৯)। স্বামীজি বেঁচে থাকলে দেখতেন নেহরু ঠিক সেটিই করলেন। |
আসলে নেহরুর কেমব্রিজে একটু বিজ্ঞান পড়া, ইংল্যান্ডে ফ্যাবিয়ান সমাজতন্ত্রের সংস্পর্শে আসা, আবার স্তালিনের কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা-আশ্রিত অর্থনীতি— সব মিলে তাঁর মস্তিষ্কে খিচুড়ি পাকিয়ে গিয়েছিল। ১৯৫০ সালে পটেলের মৃত্যু ও ’৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু (?)-র পরে তাঁর উপরে কথা বলার কেউ ছিল না। ফলে, তিনি সেই খিচুড়ি দেশবাসীকে ঠুসে গিলিয়েছিলেন এবং তারই প্রভাবে এই বিকৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।
কিছু সমাজতাত্ত্বিকের কথার সূত্র ধরে লেখক বলেছেন, “সেকুলারিজম-এর যে ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে সেটি পশ্চিম থেকে নেওয়া। এটি ভারতীয় মানসের সঙ্গে আসলে কোনও দিন সম্পৃক্ত হতে পারেনি।” ঠিকই, আর সেই কারণেই আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে জাতীয় জীবনে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির মাধ্যমে এক জঘন্য প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা মাথা তুলেছে। এই রাজনীতির মূল কথা, যারা একজোট হয়ে ভোট দেয় তারা কখনও কোনও ভুল করতে পারে না। তাদের দোষ কখনও দেখা চলবে না। মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ উল্টে দিয়ে এক দ্বিমাত্রিক মূল্যবোধ (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) চালু করার চেষ্টা হয়েছে। যার উদাহরণ গুজরাত দাঙ্গা, দিল্লির শিখ গণহত্যা ও কাশ্মীর উপত্যকা থেকে পণ্ডিত বিতাড়নকে অসমান চোখে দেখা। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভুলিয়েই দেওয়া হয়েছে।
অতএব শেষ অনুচ্ছেদে লেখকের যে প্রতিপাদ্য— “নেহরুর যে উদার বহুত্বধর্মী উন্নয়নবাদকে বাস্তবায়িত করা আজও সম্ভব হয়নি। আক্রমণাত্মক ভাবে সেই পথে এগোতেই হবে”— সেটা হবে না। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারণাটি অ-ভারতীয়। আমাদের প্রয়োজন বহুত্ববাদী রাষ্ট্র। যার সঙ্গে হিন্দু দর্শনের কিছুমাত্র বিরোধ নেই। কারণ, হিন্দুধর্ম স্বভাবতই বহুত্ববাদী। কিন্তু ভণ্ড ধর্মনিরপেক্ষতা ‘আক্রমণাত্মক’ হতে গেলে সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।
তথাগত রায়। কলকাতা-২৯
|
‘বুথে এলেন ৩৩৪, ভোট পড়ল ৫৩০’ (২৩-১১) এবং ‘কঠোর নিরাপত্তায় ফের ভোট জ্যাংড়া, হাওড়ায়’ (২৫-১১) দুটি খবরেই ‘জ্যাংড়া আদর্শ বিদ্যালয়ে’র
নাম ‘জ্যাংড়া আদর্শ বিদ্যামন্দির’ লেখা হয়েছে।
শান্তনু পাঁজা। কলকাতা-৫৯ |