প্রবন্ধ ১...
পুরুষরা একটু শিখুন, শিখতে শিখুন
ঠিক এক বছর আগে ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ধর্ষিতা হয় নির্ভয়া। সেই ঘটনার পরে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন বদলেছে। তার পরে গোটা বছরটাই কখনও দিল্লি, কখনও মুম্বই, কখনও কামদুনি... অজস্র ঘটনা ধর্ষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক বন্ধ হতে দেয়নি।
বছরের শেষ প্রান্তটাতেও ধর্ষণই শিরোনামে রইল, সৌজন্যে তরুণ তেজপাল। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ যে ধর্ষণের মামলাই আনতে চেয়েছে, সেটা সম্ভব হয়েছে নতুন আইনের জন্য। সংশোধিত আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞার পরিধি বেড়েছে। সেই কারণেই এক বছর আগে হলে যে ঘটনাটা যৌন হেনস্তার তকমা পেত, সেটা এখন ধর্ষণের আওতায় পড়ছে। এটা খুব বড় দিক। এক ভাবে ২০১২ থেকে ২০১৩-র ডিসেম্বর, একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল বলেও ভাবা যেতে পারে।
আবার অন্য কিছু দিক থেকে তেজপালের এই ঘটনাটা বেশ আলাদা। তার মধ্যে অনেকগুলো সূক্ষ্ম পরত রয়েছে। আর পাঁচটা ধর্ষণ মামলার সঙ্গে এক করে দেখলে সেই পরতগুলো হারিয়ে যেতে পারে। আর সেটা হলে নারী আন্দোলনের ক্ষতি বই লাভ হবে না। ইতিমধ্যেই এই ঘটনাটির সূত্রে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি এবং বিশাখা নির্দেশিকা (১৯৯৭) নিয়ে আবার এক প্রস্ত কথাবার্তা শুরু হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আরও বেশি করে এই জাতীয় ঘটনার বিশেষত্বের দিকটা নজর করা দরকার বলে মনে হয়।
উত্তরকাণ্ডের শুরু। ধৃত তরুণ তেজপাল, গোয়া, ৩০ নভেম্বর, ২০১৩। ছবি: পি টি আই।
গত এক-দেড় দশকে সার্বিক ভাবে কাজের জায়গায় মেয়েদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বেড়েছে তো বটেই, বিশেষ করে বেশ কিছু পেশা, যা দীর্ঘ কাল যাবৎ পুরুষ-অধ্যুষিত হয়েই ছিল, সেখানেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশ একটু হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে। কর্পোরেট জগৎ এবং মিডিয়া তার মধ্যে অন্যতম। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই ক্ষেত্রগুলোতে, স্বাভাবিক ভাবেই, লিঙ্গসম্পর্কের পরিসরটা খুব বেশি করে ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যে সব মেয়ে এই জাতীয় পেশায় আসছেন, তাঁদের সকলেই কমবেশি শিক্ষিত, আত্মসচেতন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। (উচ্চাকাঙ্ক্ষা শব্দটাকে নেতিবাচক ভাববার কোনও কারণ নেই কিন্তু— কাজের জায়গায় উন্নতি এবং স্বীকৃতি অর্জন করতে চাওয়াটা সকলের অধিকারের মধ্যেই পড়ে)।
প্রচলিত ধারণাটা এই যে, নারী-পুরুষের মধ্যে পেশাগত সম্পর্কের জায়গায় যৌনতা অনেক ক্ষেত্রেই একটা নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে, ঘনিষ্ঠতার টোপ ফেলে অথবা গিলে উন্নতির সিঁড়িতে পা রাখা যায়। ধারণাটা ভুল নয়। আবার একমাত্র সত্যও নয়। ফের সেই বহু পরতের কথা তুলতে হবে। লক্ষ করবেন, মেয়েটি তাঁর অভিযোগপত্রে লিখেছেন যে, তেজপালও বলে উঠেছিলেন, “চাকরি টেকানোর এটাই সহজ উপায়!”
ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে উন্নতির পথে পা বাড়িয়েছেন যে নারী, তাঁকে নিয়ে সচরাচর কেউ কথা বলে না। কারণ? ওটা তো জবরদস্তি নয়। যা হয়েছে, পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে হয়েছে। গিভ অ্যান্ড টেক। আমরা ভেবে দেখি না, এর মধ্যে কতটা সত্যিকারের সম্মতি, কতটা সম্মতির ভান। ভানই যদি হবে, সম্মতি যদি না-ই থাকবে, তা হলে তিনি রাজি হলেন কেন? হলেন, কারণ— হয় তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল, নয় তাঁর মনে হয়েছিল রাজি না হলে উন্নতির সব পথ বন্ধ, বা উপলব্ধি করেছিলেন, এর চেয়ে সহজ শর্টকাট আর দুটি নেই। তিনি ঠিক না ভুল, কার দায় বেশি, সে তর্কে আমরা যাচ্ছি না। শুধু একটা ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলতে চাইছি যেখানে সম্মতির মোড়ক বজায় রেখেই এত কিছু ঘটে চলা সম্ভব।
এবং ঘটে চলে প্রতিনিয়ত। কেউ ‘সম্মতি’র সঙ্গে আপস করেন, কেউ ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’র সঙ্গে। এই আপসেরও পরত আছে। সেইখানেই তৈরি হয় যার যার নিজস্ব এক্কাদোক্কার ঘর। কে কত দূর যাবে, কতটা মেনে নেবে, মানিয়ে নেবে, গা সইয়ে নেবে, কিছু হয়নি ভাব করে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে, দাদা-কাকা বলে ডেকে নজর ঘোরাতে চাইবে, মুখোশ পরে ক্যাবলা সাজবে... এবং দিনের শেষে বুঝতে শিখবে, এগুলো সবই কাজের অঙ্গ। প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস।
এই কথাগুলো লিখতে হল, কারণ খাতায়-কলমে যা কিছু শান্তিকল্যাণ, যা কিছু সম্মতি, তার পিছনে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এমন অসংখ্য পরত। সেগুলো তরুণ তেজপালেরা অর্ধেক বোঝেন না, অর্ধেক বুঝেও না বোঝার ভান করেন। তরুণ যেমন বার বার লিখছেন, তিনি পরিস্থিতিটা বুঝতেই পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, যা কিছু হচ্ছে মেয়েটির সম্মতিতেই হচ্ছে। এইখানেই দিল্লির বাস বা শক্তি মিলস বা কামদুনি বা পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গে থিংকফেস্ট-এর ঘটনার তফাত। অন্য কোনও ঘটনায় অভিযুক্তেরা দাবি করেনি যে, তাদের কোথাও কিছু বুঝতে ভুল হয়েছিল। বোঝাবুঝি, সম্মতি-অসম্মতির প্রশ্নই ওঠেনি সেখানে। নারকীয় হিংস্রতা ছাড়া আর কোনও কথা নেই এগুলোয়। তেজপালের ক্ষেত্রে আছে, অন্তত তেজপালের তেমনটাই দাবি।
অথচ মেয়েটির বয়ান বলছে, তিনি বার বার বারণ করেছিলেন। ঘটনার যে অনুপুঙ্খ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তাতে অসম্মতি না বোঝার কোনও অবকাশ ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত পর পর দুদিন তো নয়ই। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, দুজনেই সত্যি বলছেন? মেয়েটি বারণ করেছিলেন, অথচ তরুণ বোঝেননি? সম্ভাবনার অনেকগুলো দরজা খুলে যায় তা হলে। এ ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, আদালত বলবে। কিন্তু তরুণের ওই কথাগুলো, পরিস্থিতি বিচার করতে ভুল হয়ে যাওয়ার কথাগুলো আলাদা করে ভাবায়। কেন হয় এমন ভুল? ক্রমাগত ‘সম্মতি’ আদায় করে নিতে নিতে দীর্ঘ অনভ্যাসে অসম্মতির ভাষা বুঝতে কি ভুলে যায় মানুষ? না কি, ইচ্ছেখুশি মতো কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না আর কিছু না বোঝার ভাব দেখায়?
লিঙ্গ-সম্পর্কের ভূমিকাটা এখানেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যোগাযোগের যে ব্যবধান, যে মিসকমিউনিকেশনের কথা তরুণ বলছেন, সে তো শুধু কোনও ব্যক্তির একক সমস্যা নয়। নারী ও পুরুষের মধ্যে সামগ্রিক ভাবেই থেকে গিয়েছে সেই দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। নারীর কথা শোনা, তার মনের ভাব বোঝা, তার শরীরী ভাষাকে জানা— এই সব বদভ্যাস পুরুষের কোনও কালেই নেই। জানা-বোঝার পরে তবে তো তাকে স্বীকার করা, সম্মান দেওয়ার প্রশ্ন। তাও যত ক্ষণ চেনা আদলের চেনা আচার-ব্যবহার নিয়ে কারবার, তত ক্ষণ কাজ চলে যায়। কিন্তু যেইমাত্র সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন এসে গেল, মাথা গেল গুলিয়ে।
পেশাগত জীবনে যে সব নারী এখনও ওই আপস করা সম্মতির খাতায় নাম লেখাননি, তাঁদের নিয়ে এই কারণেই পুরুষরা বড় মুশকিলে পড়েছেন। তাঁদের কাজ আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে এই মেয়েদের চলাফেরা-কথাবার্তার ধরন দেখে। মেয়েরা ঝাঁপিয়ে কাজ করছেন, রঙ্গরসিকতায় মাতছেন, প্রেম-ভালবাসা-যৌনতা নিয়ে মুক্ত কণ্ঠে কথা বলছেন, ইচ্ছে মতো পানীয়ের গেলাসে চুমুক দিচ্ছেন। জীবনটা এক কথায় নিজের শর্তে বাঁচতে চাইছেন।
কিন্তু পুরুষ তো সিঁড়িভাঙা সরলের বাইরে বেরোতে পারেননি। ফলে প্রতি মুহূর্তে ভুল হয়ে যাচ্ছে। ভুল মানে, ভুল ইশারা, ভুল প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ভুল ভাঙাতে গেলে আবার গোঁসা হচ্ছে। ‘আগের দিন হাত ধরেছিলাম, পরের দিন চুমু খাব না কেন’ জাতীয় যুক্তি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তেজপালের মতো তুখড় সাংবাদিক, খাতায়-কলমে নারীবাদী অবস্থান নেওয়া সাংবাদিকও কতকটা এই রকম যুক্তিই দিচ্ছেন। ই-মেলে নিজের ভুল স্বীকার করেও বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ভুলটা না হওয়াই ছিল অস্বাভাবিক। এমন মুক্ত চলাফেরা, উন্মুক্ত কথালাপের পরেও যে কারও অসম্মতি থাকতে পারে, সেটা উনি বুঝবেন কী করে?
ভুলটা যে আসলে একেবারে গোড়াতেই। মেয়েদের অসম্মতিকে অসম্মতি জ্ঞান না করার ভুল। মেয়েদের ভাষাকে পাঠ্য বলে মনেই না করার ভুল। প্রতিটি মেয়ের নিজের ইচ্ছে মতো নিজের লক্ষ্মণরেখা ঠিক করার অধিকার আছে, এটা ভুলে যাওয়ার ভুল। মেয়েরা কোনটা উপভোগ করছেন আর কোনটা স্রেফ সহ্য করে যাচ্ছেন, আর কোনও দিন সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলে চিৎকার করে উঠতেও পারেন, সে বিষয়ে সতর্ক না থাকার ভুল। এটা মানেই ওটা আর ওটা মানেই সেটা, এই সরলরৈখিক ফর্মুলায় আটকে থাকার ভুল।
ভুলের পাহাড় থেকে নামার একটাই রাস্তা। পুরুষ, নিজের বোধ-বুদ্ধির অহং একটু কমিয়ে চার দিকে তাকান। ধৈর্য ধরে দেখুন, শুনুন, শিখুন। শিখতে শিখুন। নইলে খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.