ছয় বৎসর যাবৎ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সামলাইয়া অবসর লইলেন পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি। উল্লেখ্য, জেনারেল কায়ানি অবসর লইলেন ‘জেনারেল’ হিসাবেই। পূর্বসূরি আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়া-উল-হক ও পারভেজ মুশারফের ঐতিহ্য মানিয়া সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি প্রেসিডেন্ট হইয়া বসেন নাই। অত্যন্ত গুরুতর পরিবর্তন, সন্দেহ নাই। আরও গুরুতর কেননা, তাঁহার কার্যকালের মেয়াদের মধ্যেই পাকিস্তানে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার তাহার পূর্ণ মেয়াদ কাটাইয়া পরবর্তী নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিয়াছে। পাকিস্তানের সদ্যোজাত গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত না ঘটাইয়া যে জেনারেল কায়ানি নিজ পদে নিজ দায়িত্বে অবিচল ছিলেন, পাকিস্তানের ইতিহাস বলিতেছে, ইহা কম কৃতিত্ব নয়।
তবে কিনা, অভ্যুত্থান না ঘটানো এক কথা। আর রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হ্রাস করা আর এক কথা। প্রথমটির অর্থ দ্বিতীয়টি হইতে পারে না, অন্তত তাহাই জেনারেল কায়ানি প্রমাণ করিয়া গেলেন। তাঁহার আমলে যে বিপুল সংখ্যক সংকটের মধ্য দিয়া পাকিস্তান গিয়াছে, তাহার প্রতিটি অঙ্কেই যে কায়ানির প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রত্যয়ী উপস্থিতি ছিল, বুঝিতে কোনওই অসুবিধা হয় না। পাক সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধুরির প্রত্যাবর্তন, প্রেসিডেন্ট জারদারির উপর লাগাতার চাপ প্রয়োগ কিংবা প্রেসিডেন্ট মুশারফের রাজনৈতিক অঙ্গন হইতে বাধ্যত পশ্চাদপসরণ: প্রতিটিতেই কায়ানির পরিচ্ছন্ন স্ট্র্যাটেজির ইশারা। ঠান্ডামাথা, স্বল্পভাষী এই জেনারেল একটি নূতন ধারা প্রবর্তন করিয়া গেলেন তাঁহার দেশে, যাহাকে বলা যায় ‘নন-ক্যু ক্যু’ কিংবা অভ্যুত্থানবিহীন সামরিক নিয়ন্ত্রণ। সম্ভবত ইহাই তাঁহার কাছে একবিংশ শতকীয় নিয়ন্ত্রণের শ্রেষ্ঠ পন্থা বলিয়া মনে হইয়াছিল: সম্মুখ জমি হইতে বহু যোজন সরিয়া থাকিয়া ‘রিমোট কন্ট্রোলে’ প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাবলির উপর কড়া নজর রাখা। পাকিস্তানের সামরিক নীতি, রাজনৈতিক চক্র, উচ্চ ধর্মীয় মহল এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে যে গোপন আদানপ্রদানের তরঙ্গ, তাহার রহস্যভেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও অধরা, ভারত তো কোন ছার। তবুও একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন ভারতীয় দৃষ্টিকোণ হইতে ধরা পড়ে। গত কয়েক বৎসরে পাক সামরিক বাহিনীর ভারত-বিরোধিতার একমুখী অ্যাজেন্ডা কিছুটা পরিবর্তিত হইয়াছে, এবং অভ্যন্তরের মৌলবাদী সন্ত্রাসের দিকে তাহার পর্যাপ্ত নজর পড়িয়াছে। সম্প্রতি পাকিস্তান যে সংঘর্ষ ও মৃত্যুর অন্তহীন প্লাবন দেখিতেছে, তাহা এই দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। এই পরিবর্তন যদি সত্যই ঘটিয়া থাকে, সে ক্ষেত্রে জেনারেল কায়ানির কিছু কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য। পুবের প্রতিবেশীর সহিত যুদ্ধ করা যে পাক সৈন্যদের একমাত্র ব্রত নয়, এই উপলব্ধি সম্ভবত তাঁহার ভবন হইতেই পাক বাহিনীতে সঞ্চারিত হইয়াছে। তবে সেনাপ্রধান হিসাবে তাঁহার ভূমিকা প্রশ্নযোগ্য হইয়া উঠে, এক, ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবটাবাদে মার্কিন বাহিনীর লাদেন-নিধন কাণ্ডে পাক সামরিক মহলের চূড়ান্ত অজ্ঞতার প্রসঙ্গে, এবং দুই, জেহাদি সংগঠন ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’-এর অনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস দমনে তাঁহার বাহিনীর ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। তাঁহার উত্তরসূরি রাহিল শরিফ তাঁহার সাফল্য ও ব্যর্থতা কত দূর বহন করিবেন, তাহার উপর কেবল পাকিস্তান নহে, গোটা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎই নির্ভর করিতেছে। |