উদাসীনতার ঘুম ভেঙে দিল্লি ভিড় জমাল ভোটের লাইনে
তা হলে কি অনীহার জাড্য দুর্বল হল? নাকি কোনও এক ঘুমের অতল থেকে সহসা জেগে উঠল দেশের রাজধানী?
শীতটা এখনও জাঁকিয়ে পড়েনি। হাফ হাতা সোয়েটারই যথেষ্ট। সকালের রোদটা পিঠে পড়লে ভাল লাগছে! আর এই নরম রোদের সকালে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ অনীহার খোলস ছেড়ে গোটা দিল্লি আজ দাঁড়িয়ে পড়ল ভোটের লাইনে।
যেমন পশ্চিম বিনোদ নগর স্কুলের মাঠ। সাত সকালেই থই থই লোক। আঠারো থেকে আশি মিলমিশ বাগান। নাহ! কোনও পরীক্ষার সিট পরেনি। ভোটের ভিড়! হ্যাঁ ভিড়-ই!
এ বারে স্কুলের ভিতরে ঢোকা যাক। উরিব্বাপ! পাঁচটা বুথ! আর তার প্রতিটার বাইরে বেশ লম্বা লাইন। ঘাড় ঘুরিয়ে খোশ গল্প, আড্ডা, মুখে হাত চাপা দিয়ে স্বামীর সঙ্গে আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া ভোটটা কাকে দেওয়া যায়! তার পর ভোট দিয়ে বেরিয়ে ‘কী যেন মস্ত কাজ করে এলাম’ গোছের ভাব চোখে মুখে।
দিল্লি ছোট রাজ্য। তবে খুব ছোট নয়। সময় কম, তাই দ্রুত ঘুরে ফেলা যাক। পূর্ব দিল্লির ময়ূর বিহার। সরকারি মডেল স্কুলে ময়ূর বিহার, খিচড়িপুর, কল্যাণপুরী এলাকার মানুষ ভোট দিচ্ছেন। একটু শুধরে বলা ভাল, ভোট দিতে ঢল নেমেছে মানুষের! মুখ দিয়ে কথাটা বেরোতেই যেন লুফে নিলেন বাইরে প্রহরারত দিল্লি পুলিশের ইন্সপেক্টরটি। বললেন, “স্কুলের নামের সঙ্গে এখানে ভোট প্রক্রিয়াও এক্কেবারে মানানসই! দেখুন না যা উৎসাহ, তাতে এই ছবিটাই নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞাপন হতে পারে। মডেল ভোট!”
ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসছেন প্রিয়ঙ্কা বঢরা। বুধবার দিল্লিতে। পিটিআইয়ের তোলা ছবি।
বাকি দিল্লি? অক্ষরধাম মন্দিরকে ডান পাশে রেখে যাওয়া যাক নয়া দিল্লি বিধানসভা কেন্দ্র। লুটিয়েন দিল্লি। ভোটের লাইনে দাঁড়ানোয় বরাবরের অনীহা। এই কেন্দ্র থেকেই গত তিনটি বিধানসভা ভোটে জিতে টানা ১৫ বছর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর তখতে থেকেছেন শীলা দীক্ষিত। এ বার হেভিওয়েট আসনটির ওজন বাড়িয়ে দিয়েছেন আম আদমি পার্টির প্রার্থী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। শীলার প্রতিপক্ষ তিনি।
কিছুক্ষণ আগে নির্মাণ ভবনে এসে ভোট দিয়েছেন শীলা। সঙ্গে সনিয়া গাঁধী। তার একটু পর রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা ও রবার্ট বঢরাও এসেছেন। তখন এখানে ছিলাম না। বন্ধু সাংবাদিকদের কাছে শুনলাম, বুথের বাইরে সে সময় লাইন ছিল। সৌজন্য দেখিয়ে শীলা-সনিয়া প্রথমে লাইনে দাঁড়ান। পরে নিরাপত্তা রক্ষীদের অনুরোধে তাঁদের লাইন ভাঙতে হয়েছে। তবে আধ ঘণ্টার মতো লাইনে দাঁড়িয়েছেন রাহুল। বেজ রঙের স্কার্ট আর অফ হোয়াইট টপ পরে এসেছিলেন প্রিয়ঙ্কা। তিনিও লাইন ভাঙেননি। বেরোনোর সময় ভাই-বোন এ-ও বলে গিয়েছেন, “শীলা আন্টিই জিতবেন।” সে তো বলবেনই। কিন্তু যেটা অবাক করার মতো ব্যাপার, লুটিয়েন দিল্লির মতো জায়গায় বুথের বাইরে লাইন দেখতে হবে, ভাবিনি!
এ বার গন্তব্য পশ্চিমে। দিল্লি-হরিয়ানার সীমান্তে পালাম গাঁও। দিল্লির বিমানবন্দরে নামার আগে প্লেন থেকে নীচে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কিছুটা ঘিঞ্জি এলাকা। এটাই পালাম গাঁও বিধানসভা কেন্দ্র। এই গাঁওয়ের মধ্যে আবার অনেক গাঁও! নাসিরপুর গাঁও, ডাবরি, শিবপুরী, হরিজন বস্তী। ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে হাজারো গলি। এসে ঢুকলাম নাসিরপুর গাঁওয়ের এস ডি এম সি গার্লস স্কুলের দোরগোড়ায়। বেলা তখন ১টা। স্কুলের মধ্যে ঢুকতে পারলাম না! ভিড়ের ঠেলায়! দু’টো লাইন। বুথের দরজা থেকে শুরু করে চলে এসেছে বাইরে! বিজেপি-র এক সমর্থক নীরজ সোলাঙ্কি জানান, সকাল ১০টা থেকেই নাকি এ রকম ভিড়!
বসন্তকুঞ্জ। দিল্লির আর পাঁচটা অভিজাত এলাকার মধ্যে অন্যতম। আভিজাত্যে উজ্জ্বল বসন্তকুঞ্জের একটা বদনাম রয়েছে! নিন্দুকেরা বলেন, ওঁরা ভোটের দিন বেরোন না! আগে থেকে শর্ট ট্রিপ সাজিয়ে রাখেন। সত্যিই কি তাই? পূর্ণ প্রজ্ঞা স্কুল চত্বর কিন্তু তা জানাল না।
একই ছবি দেখানোর প্রসঙ্গটা থাক। বরং যে প্রশ্নটা জাগছে, তা হল, দিল্লি কি সহসা জেগে উঠল? ছোট একটা পরিসংখ্যান দিলেই সন্ধান সহজ হতে পারে। গত বিধানসভা ভোটে দিল্লিতে ভোট পড়েছিল ৫৮%। তারও আগের দুই বিধানসভা ভোটে এখানে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৫৩ ও ৪৯%। আর এ বার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৭০%। গ্রেটার কৈলাস, আর কে পুরম এলাকায় ভোট পড়েছে ৭৪ থেকে ৮০%! নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, বিকেল ৫টা ও দ্বারকা, ত্রিলোকপুরী, কৃষ্ণনগরে লক্ষাধিক মানুষ লাইনে থাকায় সওয়া সাতটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শীত মরশুমে দিল্লির এই জড়তা ভাঙার কারণ সন্ধানের ইচ্ছা হচ্ছে না? ময়ূর বিহারের ভোট কেন্দ্র থেকে বেরনোর সময় আরতি মিশ্র বাম হাতের তর্জনীটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। ‘‘দেখুন, দাগটা ফিকে না?” মুখ কিন্তু উজ্জ্বল। বোঝা যাচ্ছে, দাগটা গাঢ় হলে আরতির আরও ভাল লাগত। জানতে চাইলাম। প্রথম বার? বললেন, “হ্যা।ঁ পরিচয়পত্র পেয়েছিলাম লোকসভা ভোটের সময়, কিন্তু ভোট দেওয়া হয়নি।” কেন? “ভুল করেছিলাম। দেওয়া উচিত ছিল।” নাসিরপুর গাঁওয়ে দেখেছি, তালিকায় নাম না খুঁজে পেয়ে কেঁদে ফেলেছেন সুনীতা দেব। একই কারণে বিক্ষোভ হয়েছে চিত্তরঞ্জন পার্ক, লক্ষীনগর এলাকায়। বসন্তকুঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত আমলা জানালেন, “ভোট দেওয়া তো নাগরিক অধিকার। ভোট না দিলে অন্যায় হবে।”
দিল্লিতে এর আগে সব থেকে বেশি ভোট পড়েছিল ১৯৯৩ সালে। ৬১.৮%। রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মতে, সে বছর প্রথম বার দিল্লি রাজ্যের মর্যাদা পায়। তা ছাড়া বাবরি পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক উন্মাদনাও তাতে যোগ হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকেই ভোট দেওয়া নিয়ে অনীহা গ্রাস করতে থাকে দেশের রাজধানীকে।
এ বার কী হল? আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা যোগেন্দ্র যাদবের দাবি, “এর কৃতিত্ব দিতে হবে আপ এবং অণ্ণা হজারের আন্দোলনকে। অণ্ণার আন্দোলনের সময় থেকেই দিল্লির মানুষ পথে নামতে শুরু করেন। তাঁদের ঘুম ভাঙে। পরবর্তী কালে দিল্লিতে গণধর্ষণের পর মানুষের বিক্ষোভ বুঝিয়ে দিয়েছে, আর মুখ ফিরিয়ে থাকবে না দিল্লি।” একই সঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, “অরবিন্দ কেজরিওয়ালের এ বার মূল প্রচারই ছিল, ৪ ডিসেম্বর ব্রত রাখুন। ভোট দিয়ে তবেই উপোস ভাঙুন।” বিজেপি নেতা নলিন কোহলি আবার বলছেন, “খেয়াল বা ঝোঁক দু’দিনেই নিভে যায়। এটা কোনও ঝোঁক নয়, জ্বালা। দিল্লিতে পরিবর্তন চাইছেন মানুষ।” বলার প্রয়োজন নেই, ভোট শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে আগামী ক’দিনে আরও ময়নাতদন্ত হবে। বিশেষ করে মহিলা ও যুব সমাজের বেশি সংখ্যায় ভোট দেওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা হবে। তবে আজকে এটুকু বললেই হয়তো যথেষ্ট যে, বহু দিন পর গণতন্ত্রের উৎসব হল রাজধানীতে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.