ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে রেড রোডের পাশে অন্তত এক মাস ধরে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল বলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানতে পেরেছে পুলিশ। লালবাজার সূত্রের খবর, ওই সুড়ঙ্গের পাশে ঢিপি করে রাখা মাটির নমুনা পরীক্ষা করে স্টেট ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, মাসখানেক আগে খোঁড়া মাটিও ওই নমুনার মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ, ময়দান এলাকায় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরের সামনে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পুলিশ ও সেনার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ঘটনা। ফলে সব মিলিয়ে শহরের সুরক্ষা ব্যবস্থায় গাফিলতিই যে ফের প্রকট হল, তা লালবাজারের কর্তাদের একাংশ স্বীকারও করে নিচ্ছেন।
গত ২৮ নভেম্বর রাতে রেড রোডের পাশে ১২ ফুট লম্বা ওই সুড়ঙ্গের হদিস মেলে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, টেলিফোনের পুরনো কেব্ল চুরি করতে ওই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে কয়েক জন দুষ্কৃতী। চুরির অভিযোগে ছয় দুষ্কৃতীকে গ্রেফতারও করে ময়দান থানার পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, কেব্ল বেচে মাদকের টাকা জোগাড় করার উদ্দেশ্যেই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল।
খাস কলকাতা শহরে সাধারণ মাদকাসক্তেরাই যেখানে পুলিশি নজরদারিকে এত দিন ধরে বুড়ো আঙুল দেখাল, সেই জায়গায় জঙ্গিরা নাশকতামূলক কাজের জন্য কিছু করতে গেলে পুলিশ কী ভাবে আটকাবে বা আদৌ ঠেকাতে পারবে কি না, এই ঘটনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। অথচ, ছিনতাইপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত গোটা ময়দান তল্লাটে এমনিতেই পুলিশি নজরদারি বেশি থাকে। |
ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে সেই সুড়ঙ্গ। —নিজস্ব চিত্র |
ময়দান থানার ওসি এবং অতিরিক্ত ওসি নিজেরাই রোজ নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওই এলাকায় টহল দেন। থানা থেকে মোটরবাইক ও সাইকেলেও টহলদারি চলে। পায়ে হেঁটেও নজরদারি চালায় থানার পুলিশ। যেখানে ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে, তার কাছাকাছিই ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি দেয়। আবার ঘোড়সওয়ার পুলিশও নিয়মিত ওই গোটা এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।
এর সঙ্গেই ওই জায়গায় টহলদারির জন্য রয়েছে লালবাজার থেকে মোতায়েন করা রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড (আরএফএস) ও হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড (এইচআরএফএস) অর্থাৎ, পুলিশের দু’টি গাড়ি। শুধু তা-ই নয়, ফোর্ট উইলিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের আশপাশে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও গোয়েন্দা বিভাগও নজরদারি চালায়। সব চেয়ে বড় কথা, বাড়ি থেকে বিধানসভায় বা ধর্মতলায় কোনও সভা-সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাধারণত রেড রোড ধরেই যান।
রেড রোড যেখানে, সেই ময়দান চত্বরের মালিকানা সেনাবাহিনীর। ময়দান এলাকা জুড়ে বিভিন্ন ক্লাব বা সংস্থার যত তাঁবু রয়েছে, যত মাঠ রয়েছে, সে সবের মালিকও সেনাই। ময়দান এলাকায় নজরদারির জন্য রয়েছে সেনার বিশেষ বিভাগ ‘সেকশন কিউ’। তাতে এক জন কর্নেলের অধীনে কয়েক জন অফিসার এবং কয়েক জন জওয়ান কাজ করেন। প্রশ্ন উঠেছে ওই বিভাগের দায়িত্ব নিয়েও।
সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের মুখপাত্র তথা গ্রুপ ক্যাপ্টেন তরুণকুমার সিংহ অবশ্য দাবি করেন, “সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে রেড রোডের পূর্ব দিকে। ওই এলাকার নজরদারি করার কথা কলকাতা পুলিশের। সেনা নজরদারি করে রেড রোডের পশ্চিম দিকে, ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতরে ও তার চৌহদ্দিতে। তা ছাড়া, ময়দান এলাকায় কোথাও নির্মাণকাজ হলে তবেই তা দেখার কথা ‘সেকশন কিউ’-এর।”
তবে নজরদারিতে গাফিলতির পাশাপাশি তদন্তকারীদের ভাবিয়ে তুলেছে মাদকাসক্ত কেব্ল চোরদের নেটওয়ার্ক-ও। পুলিশ জেনেছে, বছরখানেক আগে বিএসএনএল ওই সুড়ঙ্গটি খুঁড়েছিল এবং ওই জায়গায় মাটির তলায় পরিত্যক্ত কেব্ল বিএসএনএলেরই। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরে বিএসএনএল তা মাটি দিয়েই বুজিয়ে দেয়। ফলে ওই জায়গার মাটি এমনিতেই নরম ছিল এবং নতুন করে মাটি খুঁড়ে ওই সুড়ঙ্গ তৈরি করতে দুষ্কৃতীদের তেমন বেগ পেতে হয়নি বলে পুলিশের বক্তব্য। কিন্তু ঠিক ওই জায়গায় যে বিএসএনএলের পুরনো আমলের কেব্ল রয়েছে এবং এক বছর আগে বিএসএনএল যে মাটি খুঁড়েছিল, দুষ্কৃতীরা জানল কী ভাবে?
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “আমরা জেনেছি, বিএসএনএলের এক বা একাধিক কর্মীর সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগসাজশ রয়েছে। আমরা তাঁদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।” এই সূত্রেই পুলিশের একাংশের বক্তব্য, মামুলি কেব্ল চোরেরা তথাকথিত কড়া নজরদারিতে থাকা এলাকায় চুপিসাড়ে গর্ত খুঁড়তে সরকারি কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেললে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদীদের কাজকর্ম ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ারই আশঙ্কা।
২০০৮-এর জানুয়ারি মাসে শেক্সপিয়র সরণিতে ফুটপাথের উপরে একটি বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও পুলিশ ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, কোনও জঙ্গি সংগঠন পরীক্ষামূলক ভাবে ডিটোনেটর ছাড়া আইইডি দিয়েই ওই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। অথচ, আজ পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনও জঙ্গি সংগঠনকে চিহ্নিত বা কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তার উপর জঙ্গি সংগঠনের চাঁইদের কলকাতায় নিয়মিত আনাগোনার বিষয়টি কারও অজানা নয়। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-এর এক সময়কার ‘অপারেশনাল চিফ’ ইয়াসিন ভটকল পর্যন্ত কলকাতায় এসে বিস্ফোরক নিয়ে গিয়েছে।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “দেশ জুড়ে জঙ্গি নাশকতা অব্যাহত। আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হামলার ক্ষত এখনও পুরনো হয়নি। কেব্ল চুরির জন্য সুড়ঙ্গ তৈরিকে নিছক ছিঁচকে দুষ্কৃতীর কাজ বলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না।” |