|
|
|
|
|
|
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ |
|
সময় থাকতে শিখে রাখুন
সিন্দুকে টাকা আছে। অথচ চাবি নেই। তখন? পরিস্থিতি ঠিক তেমনই দাঁড়াবে
যদি আগে থেকে আর্থিক লেনদেন কিছুটা অন্তত শিখে না রাখেন। এখনও হয়তো
না-জেনেই দিব্যি চলছে। কিন্তু কালকের কথা কে বলতে পারে? অমিতাভ গুহ সরকার |
|
বাঙালি
চিরকাল রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত, খেলাধূলো নিয়ে মেতে থেকেছে। তাদের জ্ঞানের গভীরতা তুফান তোলে আড্ডার জমায়েতে। কর্মজীবনের সাফল্যে অনেকেই নজর কাড়েন সারা বিশ্বের। কিন্তু আর্থিক সাক্ষরতার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ এখনও বহু যোজন পিছিয়ে। স্বচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে টাকা-পয়সা ছাড়া যে গতি নেই, তা সকলেই মানেন। কিন্তু সে জন্য দৈনন্দিন আর্থিক কাজগুলি করার অভ্যাস তৈরি, বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনের বিষয় জেনে রাখা, সঞ্চয় ও লগ্নির পথগুলির ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক বোঝা, নিজের জীবনে তা কাজে লাগানো বা খুঁটিনাটি রপ্ত করার প্রয়োজনীয়তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না অনেকে। কিন্তু তার ফল কী হতে পারে, প্রথমে সেটাই দেখে নেব।
ঘটনা ১: সুমন্ত্র সেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার। ছেলে ষষ্ঠ ও মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। সংসারের সব আর্থিক দায়িত্ব একাই সামলান। একদিন হঠাৎই আন্দামানের একটি দ্বীপের শাখায় তাঁর বদলির নির্দেশ এল। স্ত্রী এম এ পাশ হলেও চেক লিখতে সড়গড় নন। এটিএম থেকে টাকা তুলতে জানেন না। ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারেও তথৈবচ। সন্তানদের স্কুল ফি, বিমার প্রিমিয়াম, টেলিফোন ও বিদ্যুতের বিল মেটানো ইত্যাদি কখনও করেননি। দিশেহারা সুমন্ত্র। পরিবার চালাবে কে? |
|
ঘটনা ২: অবসর নিয়েছেন সুধাময় চৌধুরী। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও ছুটি বিক্রি বাবদ পাওয়া টাকা সঠিক ও সুরক্ষিত প্রকল্পে রেখে মাসে নিয়মিত আয় পেতে হবে। মাথায় রাখতে হবে মুদ্রাস্ফীতি ও করের দিকটাও। কিন্তু আর্থিক বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার দরুন সঞ্চয়ের জায়গাগুলো ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ব্যবসার গন্ধে ইতিমধ্যেই বাড়িতে আনাগোনা শুরু হয়েছে এজেন্ট, ব্রোকারদের। সুধাময়বাবু বুঝতে পারছেন এঁদের দেওয়া প্রস্তাবের সঙ্গে তাঁর লক্ষ্য মিল খাচ্ছে না। ফলে অবসরের একমাস পরেও ধন্দে তিনি।
ঘটনা ৩: মলয় মুখোপাধ্যায়। ৬০ ছুঁই ছুঁই। হাইপ্রেশার ১০ বছরের সঙ্গী। হঠাৎই সেরিব্রাল অ্যাটাক। ভর্তি আছেন এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিসিইউ-তে। মোটা খরচ পড়বে এই ধাক্কা সামলাতে। কিন্তু টাকার সব হদিস জানেন না স্ত্রী পরমা। শেখেননি ব্যাঙ্ক, মিউচুয়াল ফান্ডের সঙ্গে লেনদেন করতে। জানেন না কী করে মেডিক্লেম পলিসির শর্ত অনুযায়ী চিকিৎসা খরচ ফেরত মেলে। একমাত্র ছেলে বিদেশে।
ঘটনা ৪: পরেশ প্রামাণিক হুগলির চাষি। জমিজমা মন্দ নয়। মুদি দোকানও আছে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। গ্রামে বছর কয়েক হল দফতর খুলে বসা এক ফিনান্স কোম্পানির এজেন্ট পরেশকে বোঝাল কী করে তাদের কাছে টাকা রাখলে তিন বছরে দ্বিগুণ হয়। শোনাল ৫০,০০০ টাকা জমা রেখে মাসে ২০০০ টাকা সুদ পাওয়ার গল্পও। উপহার মিলবে রেডিও, ঘড়ি। পরেশ লোভে পড়ে মোটা টাকা দিয়ে দিলেন। পরিবর্তে পেলেন কাঁচা রসিদ। দু’মাস না-পেরোতেই তালা ওই দফতরে। এজেন্ট ফেরার। কোম্পানির দেওয়া রেডিওতে পরেশ জেনেছেন এই রকম অনেক কোম্পানিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। অসহায় পরেশ মাথা চাপড়ায়।
ঘটনা ৫: একমাস হল পিতৃ বিয়োগ হয়েছে প্রবোধ সিনহার। বাবার কাগজপত্র ঘেঁটে মিলেছে একগুচ্ছ শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ডাকঘর ও ব্যাঙ্ক জমার কাগজপত্র। সর্বক্ষণ বিজ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন প্রবোধবাবু সে সব বোঝেন না। ফলে অথৈ জলে।
ঘটনা ৬: দিব্যকান্তি দত্ত নামী ডাক্তার। পসার ভাল। আয়ের সিংহভাগ নগদে। কিছু ব্যাঙ্কে জমা দেন। বাকিটা নগদেই জমে। কোনও হিসেব রাখা হয় না। সম্পত্তি গড়ে উঠেছে অনেকটা। কিন্তু আয়কর রিটার্নে সব কিছু ঠিকমতো দেখানো হয় না। একদিন আয়কর দফতরের চিঠি পেলেন আয়সংক্রান্ত সব রকম কাগজপত্র নিয়ে দেখা করার জন্য। চেম্বার ফেলে এখন ছোটাছুটি চলছে আয়কর বিশেষজ্ঞদের ঘরে।
ঘটনা ৭: শিখা মিত্র কিছুদিন হল স্বামীকে হারিয়েছেন। সুদের টাকায় সংসার চলে। এক বিমা এজেন্ট নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১০ বছর মেয়াদি এক পলিসি করিয়ে নিল তাঁকে দিয়ে। ৫০ হাজার টাকার চেক সই করিয়ে বলল, এটি একক প্রিমিয়াম পলিসি। অর্থাৎ আর প্রিমিয়াম লাগবে না। পলিসিপত্র ক্যুরিয়র মারফত পেলেনও শিখাদেবী। তবে সে সব পড়ে বোঝার মতো জ্ঞান তাঁর নেই। কাগজ তুলে রাখলেন আলমারিতে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ফের প্রিমিয়ামের নোটিস। মাথায় হাত শিখাদেবীর। কাগজপত্র দেখে এক পড়শি জানালেন এজেন্ট মিথ্যে বলেছে। প্রতি বছরই জমা করতে হবে প্রিমিয়াম। কিন্তু সেই সামর্থ শিখাদেবীর নেই। এজেন্ট বেপাত্তা।
আপনার পরিণতি?
উপরের প্রত্যেকে আলাদা মানুষ। শিক্ষা, সম্পত্তি, জীবনযাপন, সামাজিক অবস্থানও আলাদা আলাদা। কিন্তু এক অসহায় পরিণতি এক জায়গায় এনেছে সকলকে। যার কারণ তাঁদের নিজেদের কিংবা একা পড়ে যাওয়া প্রিয়জনের ন্যূনতম আর্থিক জ্ঞানটুকু না-থাকা। এই অক্ষমতা থাকলে, যে কোনও মুহূর্তে আপনিও এমনই কোনও অবস্থায় পড়তে পারেন। অর্থাৎ—
• প্রতারিত হতে পারেন।
• যথেষ্ট আয় করলেও প্রয়োজনের সময় টাকার অভাব হতে পারে।
• টাকা থাকলেও অজ্ঞানতার কারণে সময়ে তা ব্যবহার করতে পারবেন না।
• সঞ্চয় প্রকল্প বাছায় ভুল হতে পারে।
• কর-সমস্যায় পড়তে পারেন।
• সংসার অচল হয়ে যেতে পারে।
• তীব্র অনটনে তৈরি হতে পারে।
• অপচয় বা লোকসান হতে পারে।
অঙ্কে পাশ করবই
কাজেই এর থেকে শিক্ষা একটাই— অঙ্ক ভাল লাগত না, কিন্তু প্রতি বছর পাশ করার তাগিদে সেটা অভ্যেস তো করতে হয়েছে। নম্বর ভাল রাখার জন্য ‘ভাল না-লাগার’ বিষয়টি নিয়ে অনেক পরিশ্রমও করেছেন। তা হলে আর্থিক কাজকর্মের ক্ষেত্রেই বা তা হবে না কেন। বরং এর সঙ্গে তো জড়িয়ে আছে বেঁচে থাকা, না-থাকার প্রশ্ন।
শোধরানোর পথ
এই সব সমস্যা থেকে বেরোতে আর্থিক সাক্ষরতা প্রসারের দায়িত্ব নিতে হবে সমাজের অনেককেই। যেমন—
• গৃহকর্তা যিনি নিজেই একক ভাবে টাকাপয়সার দিকটি দেখেন, তিনি চেক লেখা, এটিএম কার্ড ব্যবহার করা, সময় মতো বিমার প্রিমিয়াম জমা করা, ১৫জি/এইচ ফর্ম জমা করা ইত্যাদি কাজ শিখিয়ে দেবেন বাড়ির মহিলাদের। কারণ এই সাধারণ জ্ঞান বিশেষ করে প্রয়োজন বাড়ির মহিলাদের।
• ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান যারা সমাজ থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে, তারা শহরে এবং গ্রামেগঞ্জে আর্থিক সাক্ষরতা অভিযান চালাতে পারে। এই ব্যাপারে ব্যবহার করতে পারে বিশাল এজেন্ট/ব্রোকার বাহিনীকে।
• আয়কর দফতরকেও আর্থিক শিক্ষা প্রসারে জোর দিতে হবে।
• সরকারের শিক্ষা দফতর ভাবতে পারে স্কুলের উঁচু ক্লাসে বা কলেজ স্তরে অর্থশিক্ষার ব্যাপারে একটি পৃথক বিষয় আবশ্যিক ভাবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা।
• প্রত্যেক মহিলার নামে একটি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে ও তাঁদেরকেই তা পরিচালনা করতে দিতে হবে।
• পাড়ার ক্লাব, পুজো কমিটি, হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন, এনজিও এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এই ব্যাপারে উদ্যোগী হলে কাজ দ্রুত এগোবে। |
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ |
|
|
|
|
|