হাইওয়ের পাশে ধাবা। গরমাগরম তড়কা-রুটি, তন্দুরি মুরগির ভোজের সঙ্গে, চাইলেই প্রায় ভোজবাজির মতোই, টেবিলে চলে আসে বিয়ারের বোতল, রাম বা মাঝারি দামের হুইস্কির পেগ। জমে যায় খানা-পিনা। হোটেল মালিকের ব্যবসাও জমে ওঠে। কিন্তু টাকা মার যায় আবগারি দফতরের।
রাজ্য আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জাতীয় সড়কগুলির পাশে হোটেল-ধাবাগুলির একটা বড় অংশ লাইসেন্স ছাড়াই মদ পরিবেশন করছে। নষ্ট হচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এ বার তাই ধাবাগুলোকে মদের লাইসেন্স নেওয়ার আবেদন জমা দিতে উৎসাহ দিচ্ছে রাজ্য সরকার। গত তিন মাসে অনেকগুলি ধাবা আবেদন করে লাইসেন্স পেয়েও গিয়েছে বলে জানা গিয়েছে নানা জেলা থেকে।
আবগারি দফতরের এক শীর্ষকর্তার দাবি, “এটা হলে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে, বেআইনি মদের দোকানগুলিও বন্ধ হবে।” তবে প্রাথমিক ভাবে বসে মদ খাওয়ার (অন শপ) লাইসেন্স দেওয়া হবে, বোতলবন্দি মদ বিক্রির (অফ শপ) লাইসেন্স দেওয়া হবে না। ধাবা বা হোটেলের নিজস্ব জমিতে তৈরি বা ভাড়ায় নেওয়া বাড়ি থাকতে হবে। তিনশো মিটারের মধ্যে কোনও মন্দির-মসজিদ বা স্কুল-কলেজ থাকা চলবে না। এই নিয়মকানুন মেনে কেউ আবেদন করলে তা লাইসেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
কেন লাইসেন্স দেওয়ার জন্য এই তৎপরতা? আবগারি দফতর সূত্রে খবর, পুজোর মরসুমে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আবগারি দফতর জন্য বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি রাজস্ব। দফতরের কর্তাদের অনুমান, মদের বিক্রি না কমলেও, ক্রেতাদের একটা বড় অংশ মদ কিনেছেন লাইসেন্স-হীন ধাবা বা হোটেল থেকে। কেবল ধরপাকড় করে লাভ হবে না বুঝে ছোট ছোট ধাবা-হোটেলগুলিতে মদ পরিবেশন বৈধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে দফতর।
সেই সঙ্গে রয়েছে যত্রতত্র অবৈধ ভাবে মদ বিক্রি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ। যার জেরে সরকারও আবগারি দফতরকে অবৈধ মদে রাশ টানতে তাগাদা দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবগারি কর্তা বলেন, “এক দিকে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য চাপ দিচ্ছে মদ বিক্রি বাড়াতে, অন্য দিকে অবৈধ দোকান তোলার জন্যও চাপ দিচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমরা বেশি করে লাইসেন্স দিচ্ছি।”
আবগারি দফতরের বর্ধমান (পশ্চিম) বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু-তিন মাসে আসানসোল-দুর্গাপুর এলাকায় বড় রাস্তার পাশে ৩০টি ধাবাকে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর আবগারি দফতরের এক কর্তা জানান, রাজ্য সড়ক এবং দুটি জাতীয় সড়কের (মুম্বই রোড এবং মেদিনীপুর-রানিগঞ্জ সড়ক) পাশে বেশ কিছু ধাবা রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০টির মালিকরা আবেদনপত্র নিয়েছেন দফতর থেকে। তার মধ্যে ২২ জন আবেদন জমাও দিয়েছেন। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের চারজন ধাবা-মালিক ইতিমধ্যে লাইসেন্স পেয়েও গিয়েছেন।
কোচবিহার জেলায় ৪৫টি ধাবার একটি তালিকা জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়েছে জেলা আবগারি দফতর। দার্জিলিঙেও একটি তালিকা জমা দিয়েছিল আবগারি দফতর, কিন্তু জেলা প্রশাসন নানা কারণে তা বাতিল করে নতুন তালিকা বানাতে বলেছে।
লাইসেন্স-পাওয়া মদের দোকানের সংখ্যা অবশ্য সিন্ধুতে বিন্দু। দফতরের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, শুধুমাত্র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ২০০টির বেশি ধাবা রয়েছে। হোটেলের সংখ্যাও কম নয়। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ধাবা-হোটেলে মদ পরিবেশনের লাইসেন্স রয়েছে। এ ছাড়াও জেলা জুড়ে চায়ের দোকান থেকে মিষ্টির দোকান, সবর্ত্রই বিলিতি মদ বা চোলাইয়ের ব্যবসা চলে। বারবার অভিযোগ উঠেছে, আবগারি দফতরেরই এক শ্রেণির অফিসার এবং স্থানীয় পুলিশের একাংশের মদতে বিনা লাইসেন্সে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এই ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা।
পুলিশের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে এতদিন ব্যবসা দিব্যি চালিয়েছেন হোটেল মালিকরা। এখন লাইসেন্স সংগ্রহ করতে আগ্রহী হচ্ছেন কেন? আসানসোলের একটি ধাবার মালিক মনোজ মাজি বলেন, “আবেদন করলেও লাইসেন্স পাব সেই নিশ্চয়তা ছিল না, তাই এত দিন আবেদন করিনি। এখন আবগারি দফতর থেকে বলল আবেদন করতে, তাই জমা দিয়েছি। অনেকেই লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছেন, আমিও পাব মনে হচ্ছে।”
অবৈধ মদ বন্ধ করতে ধাবা- হোটেলগুলিতে অবৈধ ভাবে মদ বিক্রি যেমন বন্ধ হচ্ছে, তেমনই বেআইনি মদের কারখানা বন্ধেরও উদ্যোগ নিয়েছে আবগারি দফতর। এর জন্য রাজ্যে বেশ কয়েকটি নতুন রেঞ্জ অফিসও চালু হচ্ছে। সেখানে দফতরের ডিএসপি পদ মযার্দার এক অফিসার থাকবেন এবং একাধিক সাব-ইন্সপেক্টর ও আবগারি পুলিশও থাকবে। এই রেঞ্জ অফিস থেকেই জেলার সার্কেল অফিসের যোগাযোগ থাকবে। এক অফিসারের কথায়, “এতে নজরদারি বাড়বে, ধারাবাহিক অভিযানের ফলে অবৈধ মদ বিক্রেতারাও ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।” চলতি বছরের শেষ কিংবা নতুন বছরের শুরুতেই রেঞ্জ অফিসগুলি হবে। |
সহ-প্রতিবেদন: দিবাকর রায় |