বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক থেকে শুরু করে সরকারি দফতরের অনুষ্ঠান সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক বার তিনি বার্তা দিয়েছেন, কাজ ফেলে রাখা চলবে না। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মীদের উপর আরও এক ধাপ চাপ বাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, সময় মতো কাজ না করলে জরিমানা দিতে হবে।
তাঁর সরকার যে কাজ করার জন্যই ক্ষমতায় এসেছে, গত কয়েক মাসে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের বৈঠকে তা প্রায়ই বলছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে বিডিও, এসডিও, জেলাশাসক থেকে দফতরের সচিবরা পর্যন্ত কাজের প্রশ্নে তাঁর রোষের শিকার হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ঝাড়গ্রামে প্রশাসনিক বৈঠকে হাজির না থাকার জন্য মঞ্চ থেকেই কারিগরি শিক্ষা দফতরের সচিব হৃদেশ মোহনকে বদলির নির্দেশও দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। |
মুখ্যমন্ত্রী বরণ। আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের অনুষ্ঠানে।
মঙ্গলবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ছবিটি তুলেছেন রণজিৎ নন্দী। |
কিন্তু শুধু এটুকুতেই যে তিনি আটকে থাকবেন না, তা ফের স্পষ্ট হয়ে গেল মঙ্গলবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ ও আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের এক অনুষ্ঠানে এসে সরকারি কর্মীদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথা ফের শুনিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “গরিব মানুষ সরকারি পরিষেবা পেতে অনেক দূর থেকে কত কষ্ট করে আসেন। তাঁদের যদি শুনতে হয়, আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু সেটা মেনে নেওয়া যায় না। এক দিন কোনও এক কর্মীর অসুবিধা থাকতেই পারে। তাঁর শরীরও খারাপ হতে পারে। তা হলে পরের দিন তাঁকে সেই কাজ করে দিতে হবে।” এর পরেই তাঁর হুঁশিয়ারি, “কোনও সরকারি কর্মীর বিরুদ্ধে সময় মতো কাজ না করার অভিযোগ পেলে তার সত্যতা যাচাই করে জরিমানা করা হবে।” পরে ফেসবুক-এ মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, তাঁর সরকার জনপরিষেবা আইন চালু করেছে। এই আইনে সাধারণ মানুষকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি সরকারের কাছ থেকে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং সময়সীমা মেনে পরিষেবা পেতে পারেন। তিনি জানান, সরকারি কর্মীদের ভাল কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য জরিমানা দিতে হবে। জনপরিষেবার মধ্যে কী কী পড়ে, তা-ও ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনের অনুষ্ঠানে রীতিমতো নিজের উদাহরণ টেনে মমতা বলেন, “সময় মতো কাজ করতে না পারলে তো আমার মাথার মধ্যে চিন্তা থাকে। কাজ পড়ে রইল এ কথা ভেবে রাতে ঘুম আসতে চায় না। কারণ, আমরা কাজ করতে ভালবাসি।” তাঁর কথায়, “সরকারে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের কাজই তো মানুষকে পরিষেবা দেওয়া। কোনও কর্মীর ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সাধারণকে পরিষেবা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।” মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যাঁরা পরিষেবা নিতে আসেন, তাঁদের আপনার পরিবারেরই সদস্য হিসেবে ভাবেন না কেন? আপনার পরিবারের কেউ তো এ ভাবেই আর এক জনের কাছে পরিষেবা চাইতে যেতে পারেন।”
পরিষেবা নিয়ে নিছক সংখ্যাতত্ত্বের ভরসা যে তিনি করেন না, তা এর আগে একাধিক বার প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, এ সব ব্যাপারে কাজের ফিরিস্তি দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। কারণ, তিনি জেলায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের মধ্যেই থাকেন। একশো দিনের কাজ, সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্প, মিড-ডে-মিল বা কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মতো পরিষেবার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত মানুষদের নিয়মের বেড়াজালে আটকে দেওয়াটা যে তাঁর পছন্দ নয়, তা বারেবারেই প্রশাসনিক কর্তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেটা আজ আবার করলেন।
এ সবের পাশাপাশি কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধ-ধর্মঘটের দিন কাজে না এলে যে বেতন কাটা যাবে, সেই নির্দেশ সরকারি বিজ্ঞপ্তি আকারে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি চান না, কাজের সময়ে নবান্নে কর্মীরা মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ দেখিয়ে কাজের পরিবেশ নষ্ট করুন। এই মর্মে সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়েছে সম্প্রতি। প্রশাসনের কর্তাদের মতে, সরকারি অফিসের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে আঠারো মাসে বছর বলে যে রসিকতা চালু রয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী চান তাতে দাঁড়ি টানতে। কিন্তু নতুন সরকারের প্রথম আড়াই বছরেও সেই সংস্কৃতির প্রায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই ক্রমেই তিনি কঠোর হচ্ছেন এবং সেই মতো একের পর এক বার্তা দিচ্ছেন, পদক্ষেপও করছেন।
কাজ নিয়ে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েও সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না কর্মী সংগঠনের নেতৃত্ব। কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “সরকারে সবার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা আছে। কেউ দায়িত্ব পালন না করলে সরকার ব্যবস্থা নিতেই পারে। কিন্তু সময়ে কাজ না হওয়ার জন্য তো কর্মচারীরা দায়ী নন? ফাইল পড়ে থাকার জন্য অফিসারেরা দায়ী। তাই কর্মচারীদের দোষারোপ করার আগে মুখ্যমন্ত্রী বরং ওঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।”
কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতা মলয় মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “কর্মচারীরা কাজ না করলে সরকার চলছে কী করে! মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, নব্বই শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে! সেই কাজ কারা করলেন? এটা আসলে সাধারণ মানুষের কাছে কর্মীদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা।” ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)-এর নেতা সমীর মজুমদার আবার বলেন, “কর্মীরা অর্ধেক বেতনে কাজ করছেন। দ্রুত কাজ হবে কী করে!” তৃণমূল প্রভাবিত ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন-এর নেতা মৃগেন মাইতি অবশ্য মনে করেন, “মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। মহার্ঘভাতা কিছু বাকি আছে ঠিকই। কিন্তু বকেয়া মিটিয়ে দেবে সরকার। তবে এক শ্রেণির আমলা রয়েছেন, তাঁদের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তা হলে আরও দ্রুত কাজ হবে।”
কর্মচারী সংগঠনগুলি যাঁদের দিকে আঙুল তুলেছে, সেই আধিকারিকরা অবশ্য এ ব্যাপারে সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে অফিসারদের উপরে দায় চাপিয়ে দেওয়াটা কোনও কাজের নয়। তবে এ নিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে কোনও রকম বিরোধে যেতে নারাজ তাঁরা।
এ দিনের অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ জন পরিষেবা আইনের পুস্তিকা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। এই আইনের আওতায় প্রাথমিক ভাবে ১৫টি দফতর, ২টি কর্পোরেশন এবং ১২টি পুরসভাকে আনা হয়েছে। পরে সমস্ত দফতর, পুরসভা ও পঞ্চায়েতকে এর আওতায় আনা হবে বলে সরকারি সূত্রের খবর। রেশন কার্ড থেকে পুর লাইসেন্স, তফসিলি জাতি-উপজাতি থেকে জন্মের শংসাপত্র দেওয়া, ড্রাইভিং থেকে ওষুধের লাইসেন্স-সহ আরও কিছু পরিষেবাকে এই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে সাঁওতাল-লেপচা সহ রাজ্যের বিভিন্ন শ্রেণির আদিবাসী কবি-সাহিত্যিকদের সম্মান প্রদান এবং ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীদের হাতে সরকারি সাহায্য তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, এ বার থেকে আদিবাসী শিল্পীদের প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা দেবে সরকার।
|
পরিষেবা অধিকার |
• সময়ে পরিষেবা দিতে না পারলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের জরিমানা
• জরিমানা ২৫০ থেকে এক হাজার টাকা। লেখা হবে সার্ভিস বুক-এ
• ভাল কাজের পুরস্কার এক হাজার টাকা। লেখা হবে সার্ভিস বুক-এ
• নজরদারির জন্য প্রতি দফতরে থাকবে সেল
• কোন কাজ, কত দিন, নির্দিষ্ট থাকছে তা-ও
• এই সংক্রান্ত ওয়েবসাইট http://www.publicservicesright.in |
|