যে জেলায় জমি-জটে আটকে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেই পুরুলিয়ায় স্রেফ এলাকার নিরাপত্তার কথা ভেবে রক্ষী-শিবির তৈরির জন্য জমি দান করল মাওবাদী উপদ্রুত হিসাবে চিহ্নিত প্রত্যন্ত গ্রামের একটি পরিবার। মঙ্গলবার বান্দোয়ানের কুইলাপাল গ্রামের ওই পরিবার তাদের মালিকানাধীন ৬০ ডেসিমেল জমি পুরুলিয়ার জেলাশাসকের হাতে তুলে দিলেন। ওই জমির বাজারদর সরকারি হিসেব অনুযায়ীই ৬০ লক্ষ টাকা!
বান্দোয়ান ব্লকটি সরকারি খাতায় মাওবাদী প্রভাবিত হিসাবে চিহ্নিত অনেক দিন ধরে। বান্দোয়ানের অনেকটা অংশ ঘিরে রয়েছে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা। আর ব্লকের দু’পাশে এক দিকে বাঁকুড়ার বারিকুল, অন্য দিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি থানা এলাকা। ২০০৩ সালের অক্টোবরে এই বান্দোয়ান থানার কাঁটাগোড়া জঙ্গলে মাওবাদী হানায় মৃত্যু হয় থানার তৎকালীন ওসি নীলমাধব দাসের। এর পর থেকে বান্দোয়ানের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক মাওবাদী হানা সংগঠিত হয়েছে। ভোমরাগোড়া গ্রামে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি রবীন্দ্রনাথ কর ও তাঁর স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। এই বান্দোয়ানেই ল্যান্ডমাইনে ওড়ানো হয়েছে যৌথবাহিনীর গাড়ি। একের পর এক নাশকতার ঘটনায় বান্দোয়ানের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে রক্ষী-শিবির। বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুর সীমানায় থাকা কুইলাপালে একটি রক্ষী-শিবির চালু করা হয়েছিল ২০০৫ সালে। আগে এখানে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের জওয়ানেরা থাকতেন। সীমানা এলাকায় ফের মাওবাদীদের গতিবিধির আঁচ মেলায় শিবিরগুলিতে বর্তমানে জুনিয়র কনস্টেবলও মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, কুইলাপালে বর্তমানে যে রক্ষী-শিবিরটি রয়েছে, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপরিসর। নতুন শিবির গড়ার জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পুলিশকর্তারা। সেই আবেদন মেনে সরকার ৩০ লক্ষ টাকা বরাদ্দও করে। কিন্তু, টাকা পাওয়া গেলে কী হবে, জমি না মেলায় নতুন রক্ষী-শিবির তৈরির কাজ আর কিছুতেই এগোচ্ছিল না। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “নাগাড়ে চেষ্টা করেও জমি মিলছিল না। হঠাতই ওই গ্রামের এক পরিবার বর্তমান রক্ষী-শিবির লাগোয়া তাদের ৬০ ডেসিমেল জমি দিতে রাজি হয়।” জমিদাতা পরিবারের এক সদস্য, যিনি রাজ্য সরকারের কর্মীও, তিনি বলেন, “গ্রামে একটা রক্ষী-শিবির রয়েছে ঠিকই। তবে, জমি পাওয়া গেলে আরও বড় শিবির হবে। তা ছাড়া কুইলাপাল থেকে বান্দোয়ান থানার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। এলাকার নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমরা জমিটি দিয়ে দিলাম।” ওই জমিটি শরিকি মালিকানার। ভাইদের কেউ চাষবাস করেন, কেউ বা বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে সংসার চালান।
সব ভাই মিলে রেজিস্ট্রি করে ওই জমি প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ দিন বিকেলে পুরুলিয়া সদরে জেলাশাসকের হাতে জমির দানপত্র তুলে দেন তাঁরা। উপস্থিত ছিলেন জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারও। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তীর কথায়, “এটা অবশ্যই ভাল নজির। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, জঙ্গলমহলের মানুষের পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি আস্থা তৈরি হচ্ছে।” পুলিশ সুপার বলেন, “জমিটা পেয়ে খুবই ভাল হল। কুইলাপালের রক্ষী-শিবির বড় করে গড়ে তোলা যাবে।” |