স্বাস্থ্য নীতির মুখ যদি জনস্বাস্থ্যের প্রসারের দিকে ঘোরানো যায়, সঙ্গে আনা যায়
একাধিক দফতরের সংহতি, তবেই রাজ্যের শিশুমৃত্যুর সঙ্গিন
চিত্রটির পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অরিজিতা দত্ত
|
মায়েরা কেন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে সুষম খাবার নেন না, সে সম্বন্ধে অনেক গবেষণা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি কারণ প্রধান: (১) দূরত্ব এবং (২) এটা না জানা যে, এই খাবার তাঁদের ও শিশুদের অপুষ্টি কমাতে প্রভূত ভাবে সাহায্য করে। অর্থাৎ, এই পরিষেবা কতটা আবশ্যিক, সেটাই অনেক মা ঠিক মতো জানেন না। এর সঙ্গে যোগ হয় অঙ্গনওয়াড়িতে পাওয়া খাবারের গুণমান সম্পর্কে ঘোরতর সন্দেহ। বস্তুত, এই কারণগুলি যে কোনও সরকারি পরিকল্পনার সাফল্যকে কমিয়ে দেয়।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে মাতৃকালীন পরিষেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের বাধাগুলি অতিক্রম করতে গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মীদের (এ এন এম ও আশা) অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি গিয়ে মায়েদের বোঝান, কেন গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্য পরিষেবা নেওয়া প্রয়োজন, কেন হাসপাতালে প্রসব হওয়া জরুরি এবং কেন শিশুর টিকাকরণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ফলত প্রতিটি রাজ্যে, প্রতিটি আর্থ-সামাজিক স্তরে এই পরিষেবা নেওয়ার প্রবণতা বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনটা যাতে হয়, সে জন্যই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের সুষম খাবার নেওয়া ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর সম্পর্কে জানানোর কথা। কিন্তু আদতে এই দরজায় কড়া নাড়ার কাজটা বড়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আবার, রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের সংযোগ অতি ক্ষীণ। মাসের একটি শনিবার এ এন এম এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আলোচনার কথা, কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি কমই ঘটে। দুই দলকর্মীদের মধ্যে আলোচনা থাকলেও কোনও বিশেষ রূপরেখা বা সংহতি না থাকায় তা ফলপ্রসূ হয় না একেবারেই। অর্থাৎ গ্রামের গর্ভবতী মাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসেন আশাদিদিরা (যাঁরা গ্রামের মেয়ে ও স্বাস্থ্যকর্মী), এ এন এম তাঁকে গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা দেন। |
মায়ের ওজন কম হলে তাঁকে মৌখিক ভাবে সতর্ক করা হয়, ভাল খাবার খেতে বলা হয়। অন্য দিকে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কাছে তথ্যই প্রায় থাকে না যে, কোন গর্ভবতী মা অপুষ্টির শিকার। তাঁরা তখনই জানতে পারেন, যখন মা স্বয়ং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আসেন। তথ্য বলছে, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না। অর্থাৎ, গ্রামের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিশু ও নারী কল্যাণের কর্মী হাজির, তাঁরা সাধ্যমত নিজের কাজ করেন, অথচ মাঝের যোগাযোগসূত্রটি অধরা বলে তথ্য আদানপ্রদান হয় না মোটেই। অপুষ্ট গর্ভবতী মা অপুষ্ট ও অসুস্থ শিশুর জন্ম দিতে থাকেন সদ্য নবজাতকের প্রাণসংশয় ঘটিয়ে।
এ কথা একদম সত্যি যে, এই ভ্রান্ত নীতির আতুঁড়ঘর কোনও রাজ্য সরকার নয়, এটা কেন্দ্রীয় নীতির অপরিণামদর্শিতা। এন আর এইচ এম ও আই সি ডি এস, উভয় প্রকল্পেই প্রচুর বিনিয়োগ করা হলেও তার থেকে ‘রিটার্ন’ অতি নগণ্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান কিংবা মিল্ক ব্যাঙ্কের মতো উদ্ভাবনী নীতি গ্রহণ করতে পেরেছে, এই যোগসূত্রটি সে কি তৈরি করতে পারে না? অপুষ্ট এবং রক্তাল্পতায় ভোগা মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এলেই তাঁকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আশাদিদির জন্য বাধ্যতামূলক করা যায়। অন্য দিকে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যে সব শিশুর ওজন বৃদ্ধি কম হচ্ছে বলে ধরা পড়বে বা যারা অতি অপুষ্ট বলে ধরা পড়বে, তাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কাজের মধ্যে পড়বে। অতি অপুষ্ট শিশুদের চিকিৎসার জন্য পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির মতো নিউট্রিশনাল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার বা পুষ্টিগত পুনর্বাসন কেন্দ্রও গড়ে তোলা যায় পশ্চিমবঙ্গে। বিশেষত, যে সব অঞ্চলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বেশি, সেখানে। গ্রামে স্বাস্থ্য এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা একযোগে কাজ করলে, নবজাতক ও শিশুমৃত্যু অনেকটাই কমবে।
দ্বিতীয় সমস্যা সরাসরি স্বাস্থ্য দফতরের পরিকাঠামো নিয়ে। আশা ও এ এন এম-এর ভাল কাজের দৌলতে পশ্চিমবঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, গর্ভকালীন পরিষেবা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে। ইউনিসেফ-এর সমীক্ষা (২০১০) অনুযায়ী, রাজ্যে জননী সুরক্ষা যোজনা (যাতে মা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করলে বিশেষ অনুদান পেতে পারেন) সংক্রান্ত জ্ঞান পশ্চিমবঙ্গের মায়েদের মধ্যে সর্বাধিক। পিছিয়ে পড়া জেলায় (যেমন মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, পুরুলিয়া) এ ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রসার হয়েছে সর্বাধিক। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, ইউনিসেফ-এর ওই একই সমীক্ষা দেখিয়ে দিচ্ছে, যত মা প্রতিষ্ঠানে প্রসবের পুরো সময়টা নিজের ও শিশুর জন্য একটি স্বতন্ত্র শয্যা পান, সেই সংখ্যাটা এ রাজ্যে সর্বনিম্ন। একাধিক মা ও শিশু একই শয্যায় বা মেঝেতে থাকছেন। হাসপাতালের উপর অতিরিক্ত চাপের ফলে অধিকাংশ মাকেই প্রসবের পর দুদিনের আগেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবার যে পরিমাণ চাহিদা বেড়েছে, পরিকাঠামোর জোগান তাল মিলিয়ে বাড়েনি। ফলত, হাসপাতালে প্রসব হলেও নবজাতকের সংক্রমণ হচ্ছে, প্রসব-পরবর্তী পরিষেবা পাওয়াই দুষ্কর। এ এন এম বা নার্সের অপ্রতুলতার কারণে জেলার ও ব্লকের হাসপাতালে প্রসব করাচ্ছেন দাই!
মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার বিভিন্ন জেলায় অসুস্থ শিশুর চিকিৎসার জন্য এস এন সি ইউ, নিকু, পিকু প্রভৃতি চালু করেছে, যা অবশ্যই খুব ভাল। কিন্তু এই সুপার স্পেশালিটি ক্লিনিকে শয্যাসংখ্যা পনেরো-কুড়িটি, ডাক্তার-নার্স পাওয়া দুষ্কর। কলকাতার হাসপাতালেও শিশু-চিকিৎসক পাওয়া দুঃসাধ্য, জেলায় তো প্রশ্নাতীত। যদি মাতৃশয্যার পরিকাঠামো বিস্তার হয়, স্বাভাবিক প্রসব পরিষেবা যদি আরও সুসংহত হয়, তবেই শিশু ও নবজাতক মৃত্যু কমানো যাবে। ছত্তীসগঢ়ের ‘মিতানিন’ প্রকল্পের মতো এ রাজ্যে ‘প্রসব-কুটির’ পরিকল্পনা সম্ভব, যেখানে মা গ্রামের মধ্যেই পরিষ্কার জায়গায় প্রসব করতে পারবেন। স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে প্রসব পরিষেবার পরিকল্পনা এক সময় হাতে নিয়েও শেষ করা যায়নি এ রাজ্যে। এই ধরনের প্রয়াসেই কিন্তু লুকিয়ে থাকে প্রকৃত জনস্বাস্থ্য উন্নতির সম্ভাবনা। তাই নিকু, পিকু-র মতো দামি পরিষেবার সঙ্গে সাধারণ মাতৃকালীন পরিষেবা ঘরের দুয়ারে পৌঁছে দিলে তবেই শিশু ও জননীর মৃত্যু অনেকটা কমানো যাবে।
সবশেষে বলি, সরকারি অর্থে পরিকাঠামো বাড়ালেই চলবে না, প্রয়োজন তার সুষম ব্যবহার। তাই সাধারণ ভাবে সব রকম পরিকাঠামো (শয্যা, ট্রলি থেকে ডাক্তার, নার্স, গ্রুপ ডি কর্মচারী) অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও নজরদারির অভাবে তাদের বড় অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। ২০১০-এর তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত দ্বিস্তর হাসপাতালে ডাক্তারদের (যাঁরা পোস্টে আছেন) যত ঘণ্টা বহির্বিভাগে চিকিৎসা করার কথা, করছেন তার ৪৪ শতাংশ! উপস্থিত পরিকাঠামো নিয়ে বহির্বিভাগে আসা ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর চিকিৎসা অন্তত ৩৭ শতাংশ বাড়ানো যেত। গুজরাতের সমীক্ষা বলছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও পরিকাঠামো সম্পূর্ণ ব্যবহৃত হতে পারে না।
পরিকাঠামো বলতে আরও একটা কথা অত্যন্ত জরুরি। এন আর এইচ এম-এর পর গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় যথেষ্ট গতি এসেছে, এ কথা অনস্বীকার্য। বরং ক্রমাগত পিছিয়ে পড়বে শহর ও উপশহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা। এখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কথা পুরসভাগুলির। আদতে সে পরিকাঠামো বড়ই অপ্রতুল। ২০১১ সালের সমীক্ষা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, হুগলি ও মুর্শিদাবাদের শহরগুলিতে টিকাকরণ, গর্ভকালীন পরিষেবা বা জন্ম পরবর্তী পরিষেবা ভীষণ ভাবে বিপর্যস্ত। তুলনায় গ্রামে তবু পরিষেবা পাওয়া যায়। দ্রুত নগরায়ণের ফলে জনসংখ্যার চাপে যখন শহরগুলির নাভিশ্বাস ওঠে, তখন পুরসভাগুলির স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা ও কাজের খতিয়ান দেখাটা অত্যন্ত জরুরি। এই কাজটা আজও হয়নি। সারা ভারতে যখন জাতীয় শহর স্বাস্থ্য মিশন (ন্যাশনাল আরবান হেল্থ মিশন) নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে, তখন মাঝারি ও ছোট শহরগুলিতে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামোর অবস্থা দেখতে সমীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
চিকিৎসা (অসুস্থকে সেবা) ও জনস্বাস্থ্য (অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা কমানো), দুই পরিষেবাই জরুরি। কিন্তু নানা কারণে (বিশেষত চিকিৎসকের চাপে) সব দেশই চিকিৎসায় বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ গবেষণায় ধরা পড়ে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হলে মানুষের বেঁচে থাকার প্রবণতা বিশেষ ভাবে বাড়ে। তাই স্বাস্থ্য নীতির মুখ যদি জনস্বাস্থ্যের প্রসারের দিকে ঘোরানো যায়, আনা যায় একাধিক দফতরের সংহতি, তবেই রাজ্যের শিশুমৃত্যুর চিত্রটি পালটানোর সত্যিকারের সম্ভাবনা থাকে।
|