প্রবন্ধ ১...
এ বার একটু সৌজন্য দেখা যাবে কি
বিধানসভার গম্বুজওয়ালা সুন্দর প্রাসাদটিতে আমি প্রথম পা রেখেছিলাম ১২ অগস্ট, ১৯৪৬ সালে। নিতান্ত অল্পবয়স, সে দিন বুঝতে পারিনি এই তারিখটি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক আলোড়নের সূচনা করবে। মুসলিম লিগ ঘোষণা করেছে ১৬ অগস্ট তারা ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন করবে। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছে। লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ১২ অগস্টের অধিবেশনের আলোচনার, বিতর্কের বিষয় এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মুলতুবি প্রস্তাব আনা হবে।
বিধানসভার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে নানান অনুষ্ঠানের খবরের মধ্যে অতীত দিনের কথা মনে পড়ল। পিতৃবন্ধু ডেপুটি স্পিকার তোফাজ্জল আলী সাহেব হঠাৎ করেই দর্শক গ্যালারির কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা-মা’র সঙ্গে বিশাল বাড়িতে প্রবেশ করে কিঞ্চিৎ হতচকিত ছিলাম। ভিতরে ঢুকে বিশাল গোলাকৃতি হলে স্পিকারের বাঁ দিকে গ্যালারিতে আসন গ্রহণ করলাম।
বিরোধী পক্ষে চেয়ে দেখলাম, খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি আর গাঁধী-টুপির সমারোহ। ডান দিকে ট্রেজারি বেঞ্চে অনেকের মাথায় কালো টুপি, পরনে চাপকান। সে দিন যাঁদের দেখেছিলাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন নেলী সেনগুপ্তা, কিরণশঙ্কর রায়, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, জ্যোতি বসু, বিমল ঘোষ, বিমল সিংহ। কেন লিগ সরকার ছুটির দিন ঘোষণা করেছেন, তার উপর মুলতুবি প্রস্তাব স্পিকার তুলতে দিলেন না। বিনা অনুমতিতে প্রস্তাব পাঠ শুরু হতেই হট্টগোল শুরু হল, লিগপক্ষ থেকে তুমুল ডেস্ক চাপড়ানো, চিৎকার। সে দিন সভাপতিত্ব করছিলেন তোফাজ্জেল আলী। স্পিকারের কাজ সে দিনই মনে হল বেশ যন্ত্রণাদায়ক। বিনা অনুমতিতে প্রস্তাব পাঠের জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হলে আর এক প্রস্থ হইচই। তার পর বিরোধী দলেরও প্রতিবাদে কক্ষ ত্যাগ।
তুমুল তর্কবিতর্কের মধ্যে বিমল সিংহ অপর দিকে কাকে যেন ‘নবাব’ বললেন। তিনি উল্টে ওঁকে বললেন ‘জমিদারপুত্তুর’। ও মা, এখন দেখি দুজনে হেসে হেসে একসঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কানে এল, কী, জমিদারপুত্তুর বললাম, রাগ হল নাকি!
সে দিন জনপ্রতিনিধিদের কাণ্ডকারখানা দেখে কৌতুক বোধ হয়েছিল। অবশ্য সেই কৌতুকের রেশ কেটে গেল দিন তিনেকের মধ্যেই। সৃষ্টি হল এক আতঙ্কের পরিবেশ। ১২ অগস্ট যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-এর উপর আলোচনা শুনতে গিয়েছিলাম, সেই সংগ্রাম কলকাতার রাস্তায় শুরু হয়ে গেল ১৬ তারিখের বিকেল থেকেই। এর পর থেকে সাত দিন রাতে আর ঘুম হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্ত হচ্ছে নিরপরাধ মানুষজন। কারফিউ চলছে। দিনের বেলায় লরিতে করে উদ্ধার করা মানুষজন নিয়ে যাওয়া হয় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায়। রাতে দেখি রাইফেল হাতে মিলিটারি ট্রাকভর্তি সৈন্য চলাচল। সেনা নামানো হয়েছে শবদেহের স্তূপ সরানোর কাজে। মানুষ মানুষের প্রতি কত নিষ্ঠুর হতে পারে! ওরই মধ্যে চোরাস্রোতের মতো খবর আসে— বিভিন্ন এলাকায় নিজের প্রাণ বিপন্ন করেও প্রতিবেশীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষ। এখনও মানুষের শুভবুদ্ধির উপর ভরসা রাখা যায়। এ দিকে দ্রুত এগিয়ে আসে দেশভাগ, সঙ্গে স্বাধীনতাও। অগস্টের ২৪ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করা হয়।
ঘটনাচক্রে স্বাধীনতার কিছু পরেই আমার পিতৃদেব (চারুচন্দ্র চৌধুরী) বিধানসভার অন্যতম সচিব নিযুক্ত হন। অতঃপর বিধানসভা ভবনে আমার নিত্য যাতায়াত। স্পিকারের আসনে দেখি ঈশ্বরদাস জালান’কে, তার পর এলেন শৈল মুখার্জি। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান রায় চেহারায় ও কথাবার্তায় যাকে বলে টাওয়ারিং পার্সোনেলিটি। বিরোধী পক্ষে মাত্র দু’জনকে দেখতাম জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র বিরোধী দলকে গণতন্ত্র মেনে যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হত। মাঝে মাঝে মজার ঘটনাও শুনতে পেতাম। এক দিন কংগ্রেসি বিধায়ক বিধানবাবুর কাছে নালিশ করলেন: গতকাল জ্যোতি বসু নাকি ওঁদের ‘কুকুর’ বলেছেন। সে কী! বিধানবাবু কার্যবিবরণী তলব করলেন। দেখা গেল, উনি ‘whining’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, বাংলায় যার মানে অনেক সময় হতে পারে কেঁউ-কেঁউ করা। বিধানবাবু বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে দিয়ে বললেন, গত কাল বলতে পারোনি, আজ বলতে এসেছ!
বিরোধী দল বিধানসভা অবরোধ করে মাঝে মাঝেই। এক দিন বাড়ি যাবার পথ আর খুঁজে পাই না, সব গেটে বিক্ষোভ। দেখতে পেয়ে জ্যোতিষ জোয়ারদার এগিয়ে এলেন। উত্তরের গেটে বিক্ষোভ কম, সে দিক দিয়ে বার করে দিলেন। সে কালের বিধানসভা খুব ঝকমক করত। শুভ্র শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দু’পাশে বিশাল সব পিতলের টব ঘষে-মেজে উজ্জ্বল। লাল ইউনিফর্মে সোনালি জরি লাগানো পোশাকে ফাইল হাতে চাপরাশিরা নিঃশব্দে যাতায়াত করেন। দিনের পর দিন অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করার ফলে আমার সংবিধান আর রাজনীতির পাঠ নেওয়া হয়ে যায়। আর মমতাও পড়ে যায় ঐতিহ্যবাহী, সুদৃশ্য বাড়িটির উপর।
বিবাহের পর যাতায়াত কম হলেও অব্যাহত থাকে। শিশিরকুমার বসু ও আমাকে কোনও এক বিরতির সময় স্পিকার শঙ্করদাস ব্যানার্জি তাঁর ঘরে ডেকে আপ্যায়ন করেন। পরে জানতে পারি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় স্লিপ পাঠিয়েছিলেন, ‘শরৎচন্দ্র বসুর পরিবার এসেছেন, স্পিকার শুড টেক নোট।’ রাজনীতিক সৌজন্যের পরিচয়। কোনও এক সময়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কংগ্রেস ছেড়ে অপর দিকে চলে যান। ঘটনাচক্রে সে ভাষণও শুনেছিলাম দর্শকাসনে বসে। অবশ্য অল্প দিনেই তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে।
বিধানসভার সঙ্গে আমার ক্ষীণ হয়ে যাওয়া যোগাযোগ আশির দশকের গোড়ায় আর এক বার ফিরে আসে। ডাঃ শিশিরকুমার বসু পাঁচ বছর বিধায়ক ছিলেন। সে সময়ে আমার মনে হত আগেকার তুলনায় প্রাসাদোপম বাড়িটি যেন বিবর্ণ। পিতলের টব, দরজার হাতল তত ঝকঝক করে না। আমার দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে। রাজনীতির আচার-আচরণও পাল্টে গিয়েছে। রাজ্যপালের বক্তৃতার সময়ে বাধাদান, কালো পতাকা প্রদর্শন, পথের উপর শুয়ে পড়া ইত্যাদি চলছে। বিরোধী পক্ষ যেমন এ সব কাজ করছেন, শাসক দলও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। এক দিন বিরোধী পক্ষ কোনও কারণে চেম্বারের ভিতরে অবস্থান করবেন ঘোষণা করেন। আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্পিকার অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রথমে কক্ষের আলো নিভিয়ে দেওয়া, তার পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ করে দেওয়া, তবুও অবস্থানকারীদের হঠানো যাচ্ছে না। এর পর অবস্থানকারীদের উপর কক্ষের ভিতরে লাঠিচার্জ হয়। বাধ্য হয়ে অনেকে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করেন। ডাঃ শিশিরকুমার বসু আমাকে বলেছিলেন— পুলিশ তাঁকে সবিনয়ে বলেছিলেন, স্যর আপনি বাইরে যান, লেগে যাবে। সে কালের বিপ্লবী অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। তখন পুলিশ তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে করিডরে ফেলে দেয়। করিডরে পিতলের বিশাল ফুলদানিতে ধাক্কা খেয়ে জোর আঘাত পান। অনেক দিন শরীরের একটা দিক নীলবর্ণ হয়ে ছিল।
দীর্ঘ দিনের স্পিকার হালিম সাহেব সম্পর্কে বলব, নিজ দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেও তিনি সভা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। ডাঃ বসুর প্রতিও ছিলেন সহৃদয়।
পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে নানা অনুষ্ঠান ও প্রাসঙ্গিক বিতর্ক লক্ষ করছি। খুব আশা করব, সামনের পঁচিশ বছর রাজনীতিক বিচক্ষণতা ও সৌজন্যের কোনও অভাব হবে না।

ভূতপূর্ব সাংসদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.