আট মাস আগে সিউড়িতে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র স্মরজিৎ বসুর। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছিল। মঙ্গলবার দুপুরে স্মরজিতের বাবা চন্দ্রনাথ বসুর (৫৩) ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল কোচবিহার শহরের পাটাকুড়া এলাকা থেকে। বাড়ির কাছেই নিজের মুদি দোকানের ভিতর থেকে তাঁর দেহ উদ্ধারের পরে পরিবারের লোকেরা পুলিশকে সে খবর দেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, চন্দ্রনাথবাবু আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে স্ত্রী ইতিদেবীকে মোবাইল থেকে ফোন করেছিলেন। তবে কোনও সুইসাইড নোট মেলেনি। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
চন্দ্রনাথবাবুর পরিবারের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, ছেলের মৃত্যুর ব্যাপারে খুনের মামলা রুজু হলেও এত দিনেও কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় মানসিক অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছেন তিনি। পুলিশ ও সিআইডি-র অবশ্য এখনও পর্যন্ত দাবি, দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল ওই ছাত্রের। কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনুপ জায়সবাল বলেন, “চন্দ্রনাথবাবু আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়নি। তদন্ত হচ্ছে।” তবে তাঁর পরিবারের লোকজনের বক্তব্য, হঠাৎ এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, যে কারণে চন্দ্রনাথবাবু আচমকা আত্মহত্যা করতে পারেন। চন্দ্রনাথবাবুর ভাই বিশ্বজিৎ বসু এ দিন বলেন, “বাড়িতে কোনও অশান্তি ছিল না। স্মরজিতের মৃত্যুর তদন্তে গড়িমসির কারণেই দাদা আত্মহত্যা করেছেন।”

চন্দ্রনাথ বসু।
—ফাইল চিত্র। |
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ৬ মে সিউড়িতে বীরভূম ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র স্মরজিতের মৃত্যু হয়। সেখানকার তিলপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পাতরা পুকুরে বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করতে গিয়েছিলেন তিনি। বন্ধুরা স্নান সেরে ফিরে এলেও পরে ওই পুকুর থেকে স্মরজিতের দেহ উদ্ধার করেন দমকল কর্মীরা। ওই ঘটনায় পরিকল্পিত ভাবে স্মরজিকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ তোলেন ওই ছাত্রের বাড়ির লোকেরা। এমনকী ওই ব্যাপারে স্মরজিতের পাঁচ বন্ধুর নাম উল্লেখ করে সিউড়ি সদর থানায় খুনের অভিযোগও দায়ের করেন তাঁরা। অভিযোগ, প্রথমে খুনের অভিযোগ নিতে চায়নি পুলিশ। সাংবাদিক বৈঠক করে, পুলিশ ঘটনার তদন্ত নিয়ে গড়িমসি করছে বলে কান্নায় ভেঙেও পড়েছিলেন চন্দ্রনাথবাবু।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও সুবিচার চেয়ে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন ওই ছাত্রের পরিবারের লোকেরা। তবে অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেফতার করা দূর অস্ৎ, পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি বলে অভিযোগ। পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে না পেরে মৃতের পরিজনেরা গত জুলাইয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালত সিআইডি-র ডিআইজিকে ওই ঘটনার তদন্তের জন্য একজন আধিকারিক নিয়োগের পাশাপাশি তদন্ত শুরুর চার মাসের মধ্যে এই ব্যাপারে কোর্টে রিপোর্ট দেওয়ার সময়সীমাও বেঁধে দেয়। সিআইডি ঘটনার তদন্তও শুরু করেছিল।
গত নভেম্বরে চন্দ্রনাথবাবু স্ত্রী ইতিদেবীকে সঙ্গে নিয়ে সিআইডি আধিকারিকদের সঙ্গে ‘তদন্তের প্রয়োজনে’ কথাও বলে এসেছেন। এত সবের পরেও অভিযুক্তরা ধরা না পড়ায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। পরিবারের লোকদের কাছে মাঝে মধ্যেই হতাশার কথা বলতেন বলে তাঁর পরিবার সূত্রের খবর। তবে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ১৬ জানুয়ারি চার মাস পূর্ণ হওয়ার কথা। ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরার কথাও তিনি নিজেই বলতেন বলেও তাঁর পরিজনেরা জানিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, এদিন দুপুরে স্ত্রী ইতিদেবীকে ফোন করে ‘আমি চললাম, ভাল থেকো’ বলে মোবাইল সুইচড্ অফ করে দেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যে দোকান থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। চন্দ্রনাথবাবুর ভাই বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “সিআইডি-র ফোন পেয়ে নভেম্বরেই দাদা, বৌদি আমার সঙ্গেই সিউড়ি গিয়েছিলেন। তখনও বলেছিল, ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কী দাঁড়ায় দেখব। কিন্তু এত দিনেও ভাইপোকে খুনের ঘটনায় কেউ ধরা না পড়ায় কিংবা ঘটনার কিনারা না হওয়ার যন্ত্রণা ওকে কুরেকুরে খাচ্ছিল।” বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করব। তারপরে অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ ঠিক করব।”
বীরভূম পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথমে পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছিল। ১৩ মে স্মরজিতের পরিবার সিউড়ি থানায় কলেজ কর্তৃপক্ষ, হস্টেল ওয়ার্ডেন ও পাঁচ বন্ধুর বিরুদ্ধে খুনের নালিশ করেন। ঘটনার দিন কয়েক পরে ঘটনাস্থলে তদন্ত করতে পৌঁছেছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা। তিনি ঘটনা ‘পুনরাভিনয়’ করে দেখেছিলেন। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছিল, প্রত্যেককে এসপি জিজ্ঞাসাবাদও করেন। আরও পরে অভিযুক্ত দুই বন্ধুকে নিজের দফতরে ডেকেও জেরা করেছিলেন তিনি। যে অফিসার (পদ মর্যাদায় এসআই) তদন্ত করছিলেন, তাঁকে সরিয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন এক ইন্সপেক্টরকে। পুলিশ সূত্রে খবর, পুলিশের তদন্তেও ওই ছাত্রের মৃতুকে দুর্ঘটনা বলেই দাবি করা হয়েছিল। পরে তদন্তভার সিআইডি-র হাতে দেওয়া হয়। সিআইডি-রই একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের ধারণা ওই ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রের জলে ডুবে মৃত্যু আদতে একটি দুর্ঘটনাই। তবে বীরভূমের এসপি সি সুধাকর বলেন, “আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা। বিস্তারিত খোঁজ না নিয়ে কিছু বলতে পারব না।” |