নিজস্ব সংবাদদাতা • দুর্গাপুর |
গাড়ি নেই রাতের দুর্গাপুরে।
দৃশ্য এক, রাত পৌনে ১০টা। কালনা মেলে দুর্গাপুর স্টেশনে এসে নামলেন এমএএমসির বাসিন্দা সুনন্দ বসু। কিন্তু শেষ বাস বেরিয়ে গিয়েছে প্রায় এক ঘণ্টা আগে। উপায় না দেখে চড়া ভাড়া দিয়ে ট্যাক্সি চড়ে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। দৃশ্য দুই, শহরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারে সিনেমা দেখতে এসেছিলেন স্থানীয় বি-জোনের চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা অনিন্দ্য ভৌমিক। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ সিনেমা শেষ হওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে তিনি শুনলেন মিনিট পাঁচেক আগেই চলে গিয়েছে শেষ বাস। বাধ্য হয়ে সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়তি টাকা দিয়ে অটো ভাড়া করলেন তিনি।
এই ছবিগুলি কোনও ব্যতিক্রম নয়। রাত একটু বাড়তে না বাড়তেই দুর্গাপুরের রাজপথ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে বাস। মিনিবাস সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, বেনাচিতি, এ-জোন, বি-জোন, ৫৪ ফুট রুটের শেষ বাস ছাড়ত রাত ১০টা ১০ মিনিটে নাগাদ। বিধাননগর যাওয়ার শেষ বাসের সময় ছিল রাত সাড়ে ৯টা। রাত ৯টা ১০ মিনিট নাগাদ ছাড়ত এমএএমসি যাওয়ার শেষ বাস। মায়াবাজার ও নডিহা যাওয়ার শেষ বাস ছিল রাত ৯টা ১৫ মিনিটে। সব বাসই ছাড়ত দুগার্পুর রেল স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে। কিন্তু এখন বদলে গিয়েছে সময়। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে এ-জোন, বি-জোন, মায়াবাজার ও এমএএমসি গামী শেষ বাস ছাড়ার বর্তমান সময় রাত পৌনে ৯টা। মুচিপাড়া, বিধাননগর হয়ে প্রান্তিকাগামী এইট-বি রুটের শেষ বাস বাস ছাড়ে ৯টা ৩৫ মিনিটে। ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে যাওয়ার পর মিলছে একমাত্র বেনাচিতি যাওয়ার বাস। দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে এই রুটের শেষ বাস ছাড়ে রাত ১০টা ৪০ মিনিটে। |
দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় যাত্রীরা। ছবি: বিকাশ মশান। |
দুর্গাপুর শহরে আগে ছিল গুটি কয়েক সরকারি ও বেসরকারি কারখানা ও ডিএসপি, এইচএফসিএলের মতো কয়েকটি টাউনশিপ। মূলত কারখানার কর্মীরাই এই টাউনশিপগুলিতে থাকতেন। সেই সময় দুর্গাপুর পরিবহণ ব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল ‘দুর্গাপুর রাজ্য পরিবহণ সংস্থা’র উপর। কিন্তু সেই সময়ে পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় সরকারি বাসের সংখ্যা কমতে থাকে। চালু হয় বেসরকারি মিনিবাস পরিষেবা। নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে দুর্গাপুরের শিল্প ও ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। গড়ে ওঠে শপিং মল, তারকা হোটেল, বহুজাতিক সংস্থার শো-রুম ও অত্যাধুনিক বেসরকারি হাসপাতাল। রাজ্য কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও দুর্গাপুর হয়ে ওঠে অন্যতম নাম। তৈরি হয় ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আইটি পার্ক। চাকরি ও পড়াশোনার জন্য অন্য জেলা থেকে এমনকী রাজ্যের বাইরে থেকেও লোক আসতে থাকে এই শিল্প শহরে। কিন্তু পরিবহণ ব্যবস্থা পড়ে থাকে সেই মান্ধাতার আমলেই।
শহরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারে অনেকেই সন্ধ্যার পর ঘুরতে আসেন। কিন্তু যাঁদের নিজের গাড়ি নেই তাঁরা রাত ৯টার মধ্যে কাজ মেটাতে বাধ্য হন। বছর পাঁচেক আগে শহরে গ্যাস চালিত অটো চালু হয়েছে। কিন্তু রাত ৮টার পর এই অটোর দেখা পাওয়া ভার। অটো চালকদের বক্তব্য, সন্ধ্যার পর পর্যাপ্ত যাত্রী মেলে না। দুর্গাপুর রেল স্টেশনের কাছে এখনও চালু হয়নি প্রিপেড মিটার ট্যাক্সি বুথ। কারণ রেলের থেকে পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যায়নি।
কেন কমছে বাস?
বাস মালিকদের সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও সেই অনুপাতে বাসভাড়া বাড়েনি। বেড়েছে যন্ত্রাংশের দাম। বেড়েছে বেআইনি অটো ও অন্যান্য ছোট গাড়ির সংখ্যা। ‘দুর্গাপুর মিনিবাস অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি অলোক চট্টোপাধ্যায় ও ‘দুর্গাপুর প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ারস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক কাজল দে বলেন, “আগে শহরের ভরসা ছিল মিনিবাস। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যাত্রী কম হলেও বেশি রাত পর্যন্ত মিনিবাস চালানো সম্ভব হত। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই।”
জেলা পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে নতুন বাসের পারমিট চেয়ে জমা পড়া আবেদনপত্রের সংখ্যা খুব কম। ফলে এখনই রাস্তায় নতুন বাস নামার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। দুর্গাপুর পুরসভার মেয়র ও বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায় শহরে রাতের পরিবহণ নিয়ে সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হবে।”
তত দিন শহরের মানুষকে ঘড়ির কাঁটার দিকে কড়া নজর রাখতেই হবে। |