খুব ব্যস্ত নাকি?
ঋতুপর্ণা: হ্যা। আজ সারা দিনটাই নানা ব্যস্ততায় কাটল। একটা মলের ওপেনিং ছিল। নানা জায়গায় ইন্টারভিউ ছিল। ‘ভাড়াটে’ বলে একটা ছবির শ্যুটিং করছি। সেটাও ছিল। তার পর বাড়ি থেকে আসার সময় মেয়ে বায়না জুড়ল। সেটা সামলাতে গিয়ে ওকে নিয়েই আপনাদের এখানে চলে এলাম।
তা আপনি ক্লান্ত হন না? ঘুমোন-টুমোন?
ঋতুপর্ণা: (হাসি) ক্লান্ত হই একেবারে দিনের শেষে। ঘুমোই পাঁচ থেকে ছ’ ঘণ্টা।
পার্নো: (হাসতে হাসতে) ঋতুদি তো শট রেডি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পাঁচ মিনিট, পাঁচ মিনিট করে ঘুমিয়ে নেয়। আর যেই শট রেডি হয়, চোখ খুলেই গড়গড় করে ডায়লগ বলতে আরম্ভ করে।
ঋতুপর্ণা: (হাসতে হাসতে) আরে ওটা তো পাওয়ার ন্যাপ....
পার্নো, পারবেন ঋতুপর্ণার মতো যখন তখন ঘুমিয়ে এই হারে কাজ করে যেতে?
পার্নো: শিখতে হবে। ঋতুদির কাছে অনেক শেখার আছে।
|
শেখার আছে ঠিকই। কিন্তু আপনিও তো ভালই এগোচ্ছেন। অনেকে বলছেন ‘অপুর পাঁচালি’তে খুব ভাল অভিনয় করেছেন....
পার্নো: ওহ, তাই নাকি!
ঋতুপর্ণা: আমি ‘অপুর পাঁচালি’ দেখিনি, কিন্তু পার্নো যে ভাল অভিনেত্রী সেটা জানি। অনেক দিন ধরেই নানা পরিচালক আমাদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছিলেন। এ বার পরিচালক রাজা সেনের ‘খাঁচা’য় একসঙ্গে কাজ করলাম। আমি শুধু ওকে বলতাম ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’র ‘রঞ্জনা’য় ওর অভিনয় খুব ভাল। কিন্তু তার প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসেও কাজ করা উচিত।
কেন এখন তো ‘নিউ এজ’ ফিল্মই চলছে ভাল। ‘রঞ্জনা’ ইমেজ খারাপ কী?
ঋতুপর্ণা: খারাপ তো নয়। কিন্তু নানা রকমের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। পার্নোর মতো ন্যাচারাল অ্যাকট্রেস যদি সেটা করে, আরও ভার্সাটাইল হবে।
পার্নো: আমি ‘অপুর পাঁচালি’তে একজন গ্রামের মেয়ে। ‘খাঁচা’তেও নিম্নবিত্ত সমাজের অসহায় মেয়ে। নিজেকে ভাঙার চেষ্টা করছি তো।
ঋতুপর্ণা, আপনি ঋত্বিকের ‘শব্দ’ কিংবা পার্নোর ‘বেডরুম’ বা ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ দেখেছেন?
ঋতুপর্ণা: না। সত্যি আমার এই ছবিগুলো দেখা হয়নি। ইচ্ছে আছে খুব তাড়াতাড়ি দেখার। আমি ‘অপুর পাঁচালি’র কথা জানি না। কিন্তু ‘খাঁচা’য় পার্নো সমাজের নিচুতলার মেয়ের রোলে অভিনয় করেছে, যে কিনা একটা মেয়ে-পাচার চক্রের শিকার
হয়ে পড়ে। এবং আমি একজন কর্পোরেট ওম্যান, যে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়। এই রকম একটা রোলে যখন ও কাজ করছে নিশ্চয়ই পুরনো চরিত্রের ছায়া ভেঙে কিছুটা বেরোতে পেরেছে। অভিনেত্রী হতে গেলে সব সময় ইমেজ
ভাঙতে হবে এটা আমি অনেক বার বলেছি পার্নোকে। ঋত্বিকের যেমন একটা অত্যন্ত সহজ সরল ইমেজ আছে। যেটা খুব সুবিধের। যে কোনও চরিত্রের সঙ্গেই সহজে মানিয়ে যেতে পারে। ‘খাঁচা’তে ও একজন জার্নালিস্টের রোল করেছে। সেই সাংবাদিক আমার সংকটের সময়গুলোতে পাশে থাকে। একটা নির্ভরতা তৈরি হয়।
শুধু নির্ভরতা? প্রেম নয়?
ঋত্বিক: আমার চরিত্রটা কম এক্সপ্রেসিভ। নির্ভরতা থাকলেও এই সম্পর্কটাকে নির্দিষ্ট ভাবে প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। ঋতুদি তো শ্যুটিংয়ের সময় বার বার বলছিল যে আমার আর ওর সম্পর্কটা ছবিতে কোন দিকে এগোচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে না। রাজাদাকে ঋতুদি বলছিল, “তুমি বরং এদের দু’জনের মুখে একটা গান দিয়ে দাও।” রাজাদা সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বললেন, “না না, এরা ও রকম গানটান গায় না।” এই নিয়ে খুব মজা হয়েছিল শ্যুটিংয়ের সময়। আসলে পৃথিবীতে অনেক রকম সম্পর্ক থাকে তো যেগুলো অনামাই থেকে যায়। খাঁচায় আমার আর ঋতুদির সম্পর্কটা অনেকটা সেই রকম।
আপনার জীবনে কি কোনও অনামা সম্পর্ক আছে ঋত্বিক?
ঋত্বিক: আগে এ রকম সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। সবাই যায়। কিন্তু এখন আমার জীবনে স্পষ্ট নাম আছে প্রত্যেকটা সম্পর্কের।
ঋতুপর্ণা, আপনি পরিচালক রাজা সেনের ‘দেবীপক্ষ’ ছবিতে যখন অভিনয় করেন আপনার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন শতাব্দী রায় আর কোয়েল মল্লিক। এ বার একই পরিচালকের ‘খাঁচা’ ছবিতে ঋত্বিক আর পার্নোর সঙ্গে অভিনয় করলেন। সেই সময়টার সঙ্গে এই সময়টার তফাত কী? এই যে ঋত্বিক, পার্নো এরা কী অন্য রকম?
ঋতুপর্ণা: না। একই রকম। আমার সেই সময়কার কো-আর্টিস্টদের মতোই মন দিয়ে কাজ করে। তফাত কিছুই হয়নি। সেই সময়ও মেয়েদের যে বঞ্চনা ছিল এখনও তা আছে। এই যে তরুণ তেজপালের কেসটা, এখানে যেমন তারই অধীন একটি মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ‘খাঁচা’য় আমার চরিত্রটাও সেই রকম ভাবেই বস-য়ের কাছে লাঞ্ছিত হয়। তবে ‘খাঁচা’য় কোনও উচ্চগ্রামের নাটক নেই। সব কিছু খুব স্বাভাবিক সত্যের মতো ঘটে যায়।
এই যে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে অভিনয় করলেন। এটা কেমন লাগল?
ঋতুপর্ণা: ভালই তো। তবে আমরা এখানে কেউ নবীন বা প্রবীণ নই। সবাই এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করছি। আমি যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন নায়ক বা অন্য শিল্পীরা আমার থেকে বয়সে অনেক অনেক বড় ছিলেন। এখন যাঁদের সঙ্গে কাজ করছি বলা যায় তাঁরা কেউ আমার সমসাময়িক। কেউ বা বয়সে কিঞ্চিৎ ছোট।
হ্যাঁ সেটা ঘটনা। আপনি যেমন প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিতদের নায়িকা হয়েছেন, তেমনই আজ সমদর্শী বা ঋত্বিকেরও নায়িকা হচ্ছেন....
ঋতুপর্ণা: হ্যা। সেটাই বোধ হয় আমার রহস্য। যে সবার সঙ্গেই মানিয়ে যাই। এই যেমন ঋত্বিক বহু দিন ধরেই সিরিয়ালে কাজ করছে। ‘নেকলেস’ নামে একটা কমেডি ছবিতে আমরা দারুণ কাজ করেছিলাম। কী ঋত্বিক মনে পড়ে? সেই ডায়লগটা?
ঋত্বিক: হ্যাঁ মনে পড়ে তো। নেকলেসটা হারিয়ে যাওয়ার পর আমি বলছিলাম তোমাকে- ‘খোঁজো খোঁজো শিখা খোঁজো! ওটা ওয়ান ল্যাখ।’ সারা দিন ধরে আমরা নানা কথার ফাঁকে বলছিলাম ‘খোঁজো খোঁজো শিখা খোঁজো। ওটা ওয়ান ল্যাখ!’ খুব হাসাহাসি হয়েছিল এই ডায়লগটা নিয়ে। মনে আর থাকবে না...
ঋতুপর্ণা: আমি এই রকমই। সব সময়ই নতুনদের হইচই করে কাজ করতে ভালবাসি। ‘খাঁচা’ করার সময় পার্নো আর আমাকে নেওয়ার কথা তো রাজাদাই ভেবেছিলেন। কিন্তু ঋত্বিকের নামটা আমিই সাজেস্ট করেছিলাম।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সঙ্গে কাজ করাটা ঋত্বিক বা পার্নোর কাছে কতটা চ্যালেঞ্জের?
ঋত্বিক: চ্যালেঞ্জ ঠিক বলব না। বরং বলব যে ওঁর অভিনয় পেশার প্রতি যে অ্যাপ্রোচ, যে নিষ্ঠা দেখি, সেটা শিখতে চাই। তাই যে মুহূর্তেই ওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
পার্নো: একজন অভিনেত্রী যে ‘দহন’ করেছে, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ও করেছে। আবার আজকের সময় দাঁড়িয়ে ‘খাঁচা’র মতো ছবিতেও অভিনয় করছে। এখানেই তো আমার মতো জুনিয়র আর্টিস্ট ওর সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। অভিনয়ের সব রকম ধরনে ঋতুদি পটু।
ঋতুপর্ণা, আপনি ভাল লেখেনও। আমাদের আনন্দ প্লাস-য়ে এবং রবিবাসরীয়তে দুটো বড় বড় ফিচার লিখেছিলেন....
ঋতুপর্ণা: লেখাটাও আমার বেঁচে থাকার অঙ্গ। বেশির ভাগ লেখাই লিখি প্লেনে বসে। প্লেনেই তো বেশির ভাগ সময় কাটে। আপনাদের আনন্দplus-য়ে মনীষা কৈরালাকে নিয়ে লেখাটা লিখেছিলাম ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে।
ঋত্বিক: ঋতুদি সময়টাকে অসম্ভব ভাল কাজে লাগাতে পারে।
পার্নো: মাল্টিটাস্কিং করাটা ঋতুদির কাছে শিখতে হয়। ‘খাঁচা’র শ্যুটিংয়ের সময় দেখেছি এক হাতে ফোনে কান দিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে, তো অন্য কানে স্ক্রিপ্ট শুনছে। ধৈর্য, গ্রাউন্ডেড থাকা এ সবও দেখেছি ওঁর মধ্যে। ঋতুদি সুপারস্টার, কিন্তু কোনও অ্যাটিটিউড নেই। এমন অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি যাঁরা অল্প দিন হল ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে। কিন্তু কী প্রচণ্ড অ্যাটিটিউড!
‘শব্দ’তে অভিনয় করে বেশ নজর কাড়লেও ঋত্বিকের মধ্যে কিন্তু কোনও অ্যাটিটিউড দেখা যায় না। বরং কেমন যেন মুখচোরা...
ঋত্বিক: মুখোচোরা নয়। আমার মধ্যে অসম্ভব একটা কুঁড়ে সত্তা আছে। যাকে আমি খুব যত্ন করে লালনও করি।
অভিনয়ের প্রশংসা কেবল ‘শব্দ’তেই দাঁড়িয়ে রইল, এমন হবে না তো?
ঋত্বিক: প্রত্যেকটা চরিত্রে নিজের পুরোটা দিতে চেষ্টা করি। প্রশংসা পাওয়া না-পাওয়া আমার হাতে
নেই। পরিচালক সোমনাথ গুপ্তের পরের ছবিতে আমি অভিনয় করছি। চরিত্রটায় অনেক স্তর আছে। এ বার দর্শক বিচার করবে।
এই ধরনের তরুণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করলে মনের মধ্যে একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার আসে কি?
ঋতুপর্ণা: আমি এমনিতেই খুব ছেলেমানুষ। সে এদের সঙ্গে থাকি বা না থাকি। সে জন্য আমার বর সঞ্জয়ের কাছে খুব বকুনিও খাই। ও বলে, “কোনও চিন্তা ভাবনা না করে যা খুশি করে ফেলো। বারবার একই ভুল করো আর তার পর বলো ভুলটা হয়ে গেল। ইশ্শ।’ তবে হ্যাঁ আমি কোনও দিন স্টারি ট্যানট্রাম দেখিয়ে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করিনি। করবও না। গাছের তলায় বসে মেক আপ করেছি। মেক আপ ভ্যানও দেখেছি। আবার সিনেমার কর্পোরেটাইজেশনও দেখছি। নাচগানের ফ্যামিলি ড্রামাতে অভিনয় করার পর ‘অনুরণন’, ‘চারুলতা ২০১১’, ‘মিসেস সেন’, ‘মুক্তধারা’র মতো ছবিও করেছি।
কিন্তু সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের ছবির টাইটেল কার্ডে আপনার নাম দেখতে ইচ্ছে করে না? আপনার কাজ সব চেয়ে বেশি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
ঋতুপর্ণা: অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে কাজ করেছি। আর শিবপ্রসাদ আমার খুব ভাল বন্ধু। আমরা দু’জনেই কাজের ব্যাপারে খুব প্যাশনেট। বাকি যাঁদের নাম আপনি বললেন, তাঁরা প্রত্যেকেই আমার সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমন্ত্রণ জানালে নিশ্চয়ই তাঁদের
ছবির টাইটেল কার্ডে আমার নাম দেখা যাবে। (হাসি)
|