রুজির টানে মুম্বই গিয়েছিলেন ঘাটালের আবদুল (নাম পরিবর্তিত)। সেখানেই শরীরে বাসা বাঁধে এইচআইভি-র জীবাণু। হাসপাতালে চিকিৎসাও হয়। কিন্তু ভরসা করে আর মুম্বইয়ে থাকতে পারেননি আবদুল। ফিরে এসেছেন ঘাটালে। আর সেখানেই তাকে সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হয়েছে।
শুধু আবদুল নন, তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানও এইচআইভি পজিটিভ। সকলেরই চিকিৎসা চলছে। তবে গোপনে। বিশ্ব এডস দিবসে রাজ্য জুড়ে যখন নানা কর্মসূচি হচ্ছে, বারবার স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বার্তা হচ্ছে, এডস রোগীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না, তখনও আবদুল কিন্তু ভয় নিয়েই বেঁচে আছেন। ভয় একটাই, রোগের কথা যেন লোকে জানতে না পারে। তাই প্রতিবেদনে তাঁর সত্যি নামটা লেখারও অনুমতি মিলল না। ভয়ের সঙ্গে অনুতাপও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আবদুলকে। সন্দেহ, মুম্বই থেকেই আবদুলই মারণ রোগের বাহক নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাই একে একে সংক্রমিত হয়েছে স্ত্রী ও তিন সন্তানের দেহে। এ জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না আবদুল। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলেন, “ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। একার রোগ হলে যন্ত্রণা এতটা অসহ্য হত না।”
ছেলেবেলায় বাবা মারা যেতে পড়াশোনায় ছেদ পড়ে আবদুলের। এক বন্ধুর কাছে জরির কাজ শিখে চোদ্দো বছর বয়সে আবদুল মুম্বই পাড়ি দেয়। সেখানে এক বড় জরি কারখানায় কাজও জুটে যায়। মুম্বইতে থাকাকালীনই আবদুলের জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তারই মধ্যে কিছুটা টাকা জমিয়ে তিন বছর পরে গ্রামে ফিরে আসেন আবদুল। তারপর একে একে বিয়ে, দু’কামরার পাকা বাড়ি।
২০০০ সাল থেকে আবদুল রোগে পড়েন। তখন তিনি এক ছেলে এক মেয়ের বাবা। মাঝে মধ্যে জ্বর-সর্দি। গোড়ায় খুব-একটা আমল দেয়নি। আর তাতেই রোগ নির্ণয়ে ঢের দেরি হয়ে গিয়েছে। ক্রমশ আবদুল উপলব্ধি করতে থাকেন শারীরিক ক্ষমতা কমছে। এমন অবস্থায় ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন আবদুল। ইতিমধ্যে মেয়ে হয় আবদুলের। জমানো পুঁজিতে টান পড়লে বছর ছ’য়েক বাদে ফের মুম্বই। এরপরই শুরু পর হয় টানা জ্বর, কাশি। বন্ধ হয়নি ওষুধেও। শুরু হল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আবদুলের কথায়, “এক দিন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ডেকে বললেন আমি এইচআইভি পজেটিভ। গোটা বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! পরে দাসপুরের এক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল স্ত্রী, বড় ছেলে আর দুই মেয়েও এইচআইভি আক্রান্ত।”
এরপরই শুরু হয় লড়াই। প্রথমটায় এক প্রকার সামাজিক বয়কটের শিকার হতে হয়েছিল আবদুলকে। পুকুরে নামতে না দেওয়া, প্রতিবেশীদের যাতায়াত বন্ধ ছিল। তবে দাসপুরের পাঁচবেড়িয়ায় এক সংস্থার উদ্যোগে বাউল গান, পথ-নাটিকার মাধ্যমে এডস সচেতনতা শিবির হয়। তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আবদুল ছাড়া পরিবারের চার জনও যে এইচআইভি পজিটিভ, সে কথা গোপন রাখতে হয়েছে। ছবিটা কবে বদলাবে? আবদুলরা জবাব খোঁজেন, কিন্তু মেলে না। |