বিয়ে করেন ২৮ বছর বয়সে। একটি পান গুমটির উপর নির্ভর করে দুই ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটছিল। বাড়িতে খাওয়া পরার অভাবও ছিল না। ৩৫ বছর বয়সে এসে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে জীবনে একটা ভুল করলেন ওন্দার বিমলবাবু। যৌন পল্লিতে গিয়ে রাত কাটালেন তিনি। অন্য বন্ধুরা বিপদ এড়াতে পারলেও এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হলেন তিনি।
বাঁকুড়া শহরের অদূরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রামের খুব দরিদ্র পরিবারেরর মেয়ে ফুলুদেবী। বাবা ১৬ বছর বয়সেই এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই এড্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফুলুদেবীর স্বামী। ফুলুদেবীর রক্তেও ওই মারণ রোগের জীবাণুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। স্বামীর মৃত্যুর পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে তিনি বাপের বাড়িতে উঠেছেন।
ঠিক কী ভাবে এড্সে আক্রান্ত হলেন তার সদুত্তর আজও পাননি বড়জোড়া থানা এলাকার বাসিন্দা শান্তিরাম। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার তাঁর। ছোটখাটো ব্যবসা করে ভালোভাবে খেয়ে পরে দিন কাটত। ৪০ বছর বয়সে হঠাৎ পেটের রোগের আক্রান্ত হলেন। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল এইচআইভি। |
বিমলবাবু, ফুলুদেবী বা শান্তিরামবাবুদের জীবন কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবাদে প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন তাঁরা। ফিরেছেন নিজেদের পেশাগত জীবনেও। এ সবের পাশাপাশি নতুন একটা কাজেও ঝাঁপিয়েছেন ওঁরা। তাঁদের মতো আর কেউ যাতে এই মারণ রোগের শিকার না হন, এখন সে কথাই জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। অসংযমী আচরণ জীবনে যে আঁধার নিয়ে আসতে পারে, সে ব্যাপারে প্রচার করছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এড্স রোগীদের মনোবল বাড়িয়ে তাঁদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা।
রবিবার বিশ্ব এড্স দিবস উপলক্ষে বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করে এড্স রোগীদের পরিচালিত সংস্থা ‘বাঁকুড়া সোসাইটি অব পিপল লিভিং উইথ এইচআইভি এড্স’। ওই শিবিরে নিজেদের কথা বলছিলেন বিমলবাবু, ফুলুদেবী ও শান্তিরামবাবুরা। কী ভাবে তাঁরা ওই রোগে আক্রান্ত হন, তার পর কী ভাবেই বা এখন তাঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেনসব।
ফুলুদেবী বলছিলেন, “শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে আমি বাপের বাড়ির বোঝা হয়ে যাইনি। বাবার কয়েক বিঘা জমি রয়েছে। বাবার সঙ্গে এখন আমিও সেই জমিতে চাষের কাজ করি।” বিমলবাবু শোনাচ্ছিলেন, “চিকিৎসকেরা প্রথমে আমার রোগই ধরতে পারেননি। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে গিয়েছে। শারীরিক ভাবে প্রথমে দুর্বল হয়ে গেলেও সঠিক চিকিৎসায় এখন আমি অনেকটাই সুস্থ। তাই ফের দোকান খুলে বসেছি। ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছি।” শান্তিরামবাবু বলছিলেন, “আমি বসে থাকলে বউ বাচ্চারা খাবে কী? বাচ্চাগুলোর পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই সব ভেবে মনের জোরেই একদিন ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আজ আমি আগের মতোই পরিশ্রম করতে পারি। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।” |
বিষ্ণুপুরে পদযাত্রা করে বিভিন্ন সংগঠন। |
তাঁদের কথা শুনতে ভিড় করেছিলেন বাসযাত্রীদের অনেকেই। তাঁদের মনে ছিল বহু প্রশ্ন। সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন ফুলুদেবীরা। এড্স রোগ যে ছোঁয়াচে নয়, বার বার সেই কথা তাঁরা বলছিলেন। সামান্য সতর্ক হলে এই রোগ যে এড়ানো যায়, সে কথাও তাঁরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। বাস ধরার ফাঁকে বাঁকুড়ার স্কুলডাঙার বাসিন্দা সৈকত গরাই, ওন্দার যুবক তরুণ পাল, সিমলাপালের সুবীর মোদকরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কথায়, “এতদিন আমরা জানতাম এডসে আক্রান্ত হলে মানুষ শয্যাশায়ী হয়। মৃত্যুর জন্য দিন গোনা আর উপায় থাকে না। কিন্তু চোখের সামনে এঁদের দেখে আমাদের ভুল ভাঙল। নতুন অনেক কিছুই জানলাম।” ওই সংস্থার প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর দেবাশিস প্রতিহার বলেন, “এডসের কবলে পড়লে যে জীবন শেষ নয়, তার উপযুক্ত উদাহরণ এই মানুষগুলি। আমাদের সংস্থায় প্রায় ৩৫০ জন এড্স রোগী সচেতনতার কাজ করছেন।”
বাঁকুড়ার জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, “এ মুর্হূতে জেলায় প্রায় ৪৮০ জন মানুষ এড্স আক্রান্ত। তবে জেলায় এখন এড্স রোগ ধরা পড়ার সংখ্যা কমছে। মানুষ যে সচেতন হচ্ছে এটা তারই প্রমান।” |
(এইচআইভি রোগীদের নাম ও পরিচয় পরিবর্তিত)
—নিজস্ব চিত্র। |