মোহনবাগানের এর চেয়েও অনেক খারাপ সময় গিয়েছে। ছোটবেলা থেকে এটা আমার স্বপ্নের ক্লাব বলে সবুজ-মেরুন জার্সির ইতিহাসটা একটু বেশিই জানি। ঊনসত্তরের ২৮ সেপ্টেম্বর আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মোহনবাগান চুয়াত্তরের ডুরান্ড জিতেছিল পঁচাত্তরের ৯ জানুয়ারি। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে শুধু একটা টুর্নামেন্টে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
কিন্তু তাতেও মোহনবাগান নিয়ে লোকের আগ্রহ কমেনি। ক্লাবের ফুটবলারদের সম্পর্কে হয়তো আগ্রহ কমেছে। তবু ভয়ঙ্কর ট্রফি-খরার বছরগুলোতেও ক্লাবে সে রকম বড় উত্তেজনা তৈরি হয়নি। নোংরা গালাগাল হয়নি। বড় ঝামেলা বাঁধেনি। শুধু একটা কমিশন বসানো হয়েছিল, পঁচাত্তরের শিল্ডে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোল খাওয়ার পরে। মনে আছে, ২৯ সেপ্টেম্বরের সেই ম্যাচের পর সারা রাত গঙ্গায় নৌকোর ভেতর ছিলাম। বাড়ি ফিরিনি। কিন্তু দু’দিন পরই ১ অক্টোবর আমাদের বরদলৈ ট্রফি খেলতে গুয়াহাটি যাওয়ার কথা ছিল। ফলে পাঁচ গোলে হারের পরের দিনই রোজকারের মতো বিকেলে ক্লাবে গিয়েছিলাম। ধীরেনদা আর অন্য কর্তারা যথারীতি দেখলাম লনে বসে আছেন। সদস্য-সমর্থকেরা আমাদের সমালোচনা করছে ঠিকই। কিন্তু কোনও অসভ্যতামি নেই। প্রিয় দলের জয়ে উল্লাস করা আর হারে বিলাপ করাসে তো ক্লাব সমর্থকদের বরাবরের রীতি। প্রফেসর পি কে বসু সে দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমরা কী আর কোনও দিন জিতব না?” বলেছিলাম, “নিশ্চয়ই জিতব।” বরদলৈ-ই জিতেছিলাম, ফাইনালে পঞ্জাব একাদশকে হারিয়ে। তার পর তো মোহনবাগানের ছিয়াত্তর থেকে পরের বছরগুলো ইতিহাস! |
করিম-বাহিনীর পাদুকা দর্শন। রবিবার। |
কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ বার ওই রকম সুদিন ফেরা খুব মুশকিল।
কারণ, ক্লাবের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কোনও সংসারে যদি পচন ধরে, তা হলে তার লোকগুলোও ভাল কিছু করতে পারে না। মোহনবাগান প্রশাসনের পচন টিমের গায়েও এসে পড়েছে। কর্মকর্তারা এই ক্লাবে নিজেদের মৌরসিপাট্টা চির-কায়েম রাখার জন্য এমন কিছু নিম্নশ্রেণির, সামাজিক অবক্ষয় ঘটা, অজ্ঞ লোককে মাথায় তুলছে। ওই লোকগুলোকে দিয়ে মোহনবাগানের মতো ঐতিহ্যশালী ক্লাবের দৈনন্দিন কাজকর্ম সামাল দেওয়াচ্ছে যে, এই ক্লাবে গত কয়েক বছর সুস্থ পরিবেশ বলে কিচ্ছু নেই। বছর দুয়েক আগে আমি মোহনবাগানের কোচ থাকার সময় প্রয়াগের (এখন ইউনাইটেড স্পোর্টস) সঙ্গে ড্র হয়েছিল। ম্যাচের পর আমার গাড়িতে একটা বছর দশেকের ছেলে থান ইট মেরেছিল। বাচ্চা ছেলেটাকে ধরেওছিলাম আর সে আমাকে বলেছিল, “বেলেঘাটার দাদা ইট মারতে বলেছে।” চ্যালেঞ্জ করতে পারি, কোনও সদস্য-সমর্থক এ ধরনের অসভ্যতা করে না। করে কর্মকর্তাদের নিজেদের কায়েমি স্বার্থে পোষা ওই সামাজিক অবক্ষয় ঘটা আধাকর্তাদের ভাড়া করা গুন্ডারা।
অনেকে বলবেন ক্লাব কর্তারা কেন কালিদাসের মতো যে ডালে বসে আছে সেটাকেই কাটবে? নিজেদের ক্লাবের ব্যর্থতায় তাদের লাভ কী? লাভ-ক্ষতির এখানে প্রশ্ন নেই। মোহনবাগান কর্তারা ধরেই নিয়েছে, ওদের কেউ কোনও দিন চেয়ার থেকে সরাতে পারবে না। ফলে টিমের সাফল্য-ব্যর্থতা কোনও কিছুতেই ওদের কিছু যায়-আসে না। আবার ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরার তো কোনও ব্যাপার নেই!
কিন্তু অঞ্জন-দেবাশিসরা বুঝছে না, এর পর অলক্ষে মোহনবাগানে এক দিন আগুন লাগবে! |
একশো বছরের বেশি পুরনো, ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সদস্য-সমর্থক অগুন্তি। গোটা পৃথিবীব্যাপী। আমাকেই মোহনবাগানের দুর্দশায় কত লোক কত জায়গা থেকে ফোন করে দুঃখ করে। দিল্লি, কানপুর, মুম্বই, হায়দরাবাদ এমনকী সৌদি আরব থেকেও। তবে মোহনবাগান ক্লাবে এখন আর বর্ধিষ্ণু মানুষজন যান না। কেমন একটা ভয়-ভয় ভাব তাঁবু জুড়ে। যার প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই টিমের উপরও পড়ছে। তার উপর কোচ যত না মিডিয়ার সঙ্গে জনসংযোগ রাখতে ব্যস্ত, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত তার চেয়ে কম। বছর দুই আগে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের মধ্যে ওডাফা আমাকে বলেছিল, “কোচ, আমি আর পারছি না। গোড়ালির হাড় মনে হচ্ছে ভেঙে গিয়েছে।” আমি শুধু বলেছিলাম, “তুমি অন্তত আমার জন্য আর দশটা মিনিট খেলো।” তখন আমরা এক গোলে হারছি। ওডাফা ন’মিনিটের মাথায় গোল শোধ করেছিল। ম্যাচ ড্র হয়। সেই ওডাফা এখন প্রি-সিজন প্র্যাক্টিসে আসে না। অথচ, রোমারিও একবার পনেরো দিন দেরি করেছিল বলে বার্সেলোনা পরের মরসুমে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
আসল হল অনুশাসন আর চারদিকের সুস্থ পরিবেশ। বাগান খুঁড়লেও যে দুটো জিনিসেরই খোঁজ পাওয়া যাবে না! |
সবাই করিম-ওডাফাকে দুষছেন। আমি বলব সব জিনিস কোচ কেন দেখবেন? সুব্রত-শিশির-সত্যজিৎ-প্রদীপ চৌধুরীদের তো কাজে লাগানো যায়। ফুটবল কমিটি ফের গড়া হোক। তাতে ওরা থাকুক। দেখুক, কোন ফুটবলার ফাঁকি মারছে। মাঠে নেমে কে একশো শতাংশ দিচ্ছে না। ক্লাবে মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরা তো থাকবেনই। তবে কর্তা হিসেবে তাঁরা দেখুন প্রশাসন। আর টেকনিক্যাল দিকটা দেখুক সুব্রত-সত্যরা।
চুনী গোস্বামী |
|
ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস। |