শ্রদ্ধা, পরিপ্রশ্ন এবং সেবা দ্বারা শিক্ষার্থী আচার্যের নিকট শিক্ষালাভ করিবে, এই বিধান যে কালে রচিত হইয়াছিল, কালের নিয়মেই তাহা বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু সময় দূরবর্তী হইলেই কি বিধান অতীত হয়? ‘সেবা’ সম্পূর্ণ উঠিয়া যায় নাই, ভাল ফলের প্রত্যাশায় শিক্ষার্থী শিক্ষককে সেবা করিতেছে বা করিতে বাধ্য হইতেছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল নহে, কিন্তু তাহা বেনিয়মের প্রসঙ্গ। শিক্ষাগুরুকে সেবা করিয়া শিষ্য বিদ্যা লাভ করিবে, এই নিয়মের মধ্যে যে লেনদেন নিহিত ছিল, আজ আর তাহার প্রয়োজন নাই, বাজার আসিয়া শিক্ষার দাম নির্দিষ্ট করিয়াছে, অভিভাবক বা (ভর্তুকিপ্রদাতা) সরকার সেই দাম মিটাইয়া দিতেছেন। পরিপ্রশ্নের মূল্য নীতিগত ভাবে কিছুমাত্র কমে নাই, ছাত্র শিক্ষককে প্রশ্ন করিবে, প্রশ্নের মাধ্যমে আপন বোধকে পূর্ণতর করিবে, আদর্শ হিসাবে ইহা আজও কোনও অংশে কম স্বীকৃত নহে। বাস্তব অবশ্যই ভিন্নরূপ। শিক্ষক ‘নোট’ দিবেন এবং ছাত্রছাত্রী তাহা লিখিয়া মুখস্থ করিবে, এই মরুপথে সকল পরিপ্রশ্ন হারাইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহা, আবারও, অন্য প্রসঙ্গ। তৃতীয় প্রসঙ্গটি শ্রদ্ধার। ইহাই জটিলতম প্রসঙ্গ। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্পর্কে শ্রদ্ধার ভূমিকা কী এবং কতখানি? সচরাচর প্রশ্নটি ওঠে, যখন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের প্রতি কুত্সিত দুর্ব্যবহার করে। এই অশ্রদ্ধা অত্যন্ত নিন্দনীয়, কিন্তু ইহা অশ্রদ্ধার অতিসরল উদাহরণ। যে কোনও মানুষের প্রতিই এমন আচরণ নিন্দনীয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে শ্রদ্ধার অর্থ এবং ভূমিকা প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি জটিল।
ফেসবুক বা অনুরূপ সামাজিক নেটওয়ার্ক মারফত শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যোগাযোগ থাকা উচিত কি না, থাকিলে সেই যোগাযোগ কতটা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বিধেয়, এই বিষয়ে কলিকাতার কয়েকটি স্কুলের পরিচালকরা সম্প্রতি চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন, কিছু কিছু স্কুলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধও জারি হইয়াছে। চিন্তা ও উদ্বেগের প্রধান কারণ: এই ধরনের যোগাযোগের ফলে শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবন ও আচরণ ছাত্রছাত্রীর নিকট উন্মুক্ত হইতেছে, দুই তরফের মধ্যে কাম্য দূরত্ব থাকিতেছে না, তাহার ফলে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রছাত্রীর শ্রদ্ধা কমিতেছে। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা যে পড়ুয়ারা সামাজিক নেটওয়ার্কে শিক্ষকের ‘বন্ধু’ হয়, তাহারা অনেক সময় তাঁহার নিকট বেশি মনোযোগ, সহযোগিতা বা সুবিধা লাভ করে। এই বৈষম্যও শ্রদ্ধার পক্ষে হানিকর। ইন্টারনেটবাহিত সামাজিক নেটওয়ার্কের বিস্ফোরণের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিল সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়াছে, ইহা তাহারই একটি নমুনা।
পশ্চিম দুনিয়ায় এই সমস্যা অনেক দিনই প্রকট। ফেসবুকে শিক্ষক ও ছাত্রের বন্ধুত্ব থাকা উচিত কি না, এই প্রশ্নে গত কয়েক বত্সর যাবত্ বিস্তর বিতর্ক চলিয়াছে। বিভিন্ন স্কুলের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ জারি করিয়াছে। জার্মানির একটি প্রদেশে সম্প্রতি ঘোষিত হইয়াছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ দিয়া সমাধানের চেষ্টা কোনও গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক। নিরপেক্ষতা, শোভনতা, সৌজন্য, দূরত্ব, এই সকলই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুক-দুনিয়ায় এগুলি বজায় রাখা সহজ নয়। কিন্তু সেই দুনিয়ায় বিচরণ করিতে চাহিলে কঠিন কাজের দায়িত্ব লওয়াও জরুরি। সেই দায়িত্ব শিক্ষকদেরই, বিশেষত স্কুলশিক্ষকদের। শ্রদ্ধা স্বয়ম্ভূ নহে, তাহা অর্জন করিতে হয়। |