ভারতের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাজকর্ম দেখিলে মনে হয়, তাঁহারা ‘প্যান-অপটিকন’ রাষ্ট্রের তত্ত্বে পুরাদস্তুর বিশ্বাস রাখেন। সকলই দৃষ্টির আয়ত্তে থাকা চাই, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রশ্নে নিশ্চিতি চাই। সম্প্রতি মন্ত্রক একটি বিল-এর খসড়া করিল, যাহা অনুযায়ী দেশের সব কয়টি আই আই এম-এর ‘দেখাশোনা’ করিবার জন্য একটি সুপ্রিম কাউন্সিল তৈরি হইবে। এই কাউন্সিলের সামনে প্রতিটি আই আই এম-কে নির্দিষ্ট সময়ে আসিয়া কাজকর্মের হাল-হকিকত উপস্থাপন করিতে হইবে। ওই সময়পর্বে প্রতিষ্ঠানে কী ও কতটুকু কাজ হইয়াছে, তাহার বিস্তারিত বিবরণ জানাইতে হইবে, এবং কাজ না হইলে কেন হয় নাই, তাহার জবাবদিহিও করিতে হইবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টগুলির নিজস্ব পরিচালনার সর্বোচ্চ স্তরে যে বোর্ড অব গভর্নর্স বিরাজ করেন, ‘স্বশাসিত’ বলিয়া অভিহিত এই প্রতিষ্ঠানের দায়ভার তাঁহারা বহন করিবার জন্য নির্বাচিত ও নিয়োজিত। তাঁহাদের আশঙ্কা, অতঃপর আই আই এম-এ স্বশাসন বলিয়া আর কিছু থাকিবে না। সরকারি কর্তাব্যক্তিরাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নামে ছড়ি ঘুরাইবেন। অন্যান্য সরকারি শিক্ষা-ক্ষেত্রের মতো এখানেও উত্কর্ষের সাধনা অপেক্ষা নজরদারির ভজনা বেশি গুরুত্ব পাইবে।
বোর্ড অব গভর্নর্স ভুল ভাবিতেছেন না। স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাজে নাসিকা-চালনার প্রবৃত্তির উত্সটি কাহারও অজানা নহে। বিশেষত, দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান অনুযায়ী উত্কর্ষের দিক দিয়া আই আই এম-গুলি এতখানি আগাইয়া রহিয়াছে যে হঠাত্ করিয়া এত মাথাব্যথার অন্যতর কারণ থাকিতে পারে না। একটিই সম্ভাব্য দুশ্চিন্তার ক্ষেত্র থাকিতে পারে, ভর্তির ফি নিয়ন্ত্রণ। আই আই এম-গুলি যাহাতে যথেচ্ছ মাত্রায় ফি বাড়াইয়া যাইতে না পারে, সে বিষয়ে মন্ত্রক নাকি অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন। তবে সাম্প্রতিক বিলটি লইয়া আপত্তি তুলিবার মধ্যেও কিন্তু আই আই এম-এর উচ্চকর্তৃত্ব ইঙ্গিত দিয়াছেন, প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং প্রবেশিকা ফি-র বিষয়ে মন্ত্রকের কাউন্সিলের পরামর্শ তাঁহারা লইতে রাজি, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে কাউন্সিলের ছড়ি ঘোরানো চলিবে না। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভ অবশ্য মনে করে, এমনকী প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ফি-এর ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ভিন্ন কাহারও কোনও কথা গ্রাহ্য নহে, তিনি সরকারি কর্তা হউন বা না হউন। ফি বাড়াইলে যদি ছাত্রছাত্রী পড়িতে না আসে, তাহা প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথা, আর কাহারও নহে। এবং ফি বাড়াইলে যদি অপেক্ষাকৃত দুর্বল আর্থিক অবস্থানের ভাল ছাত্রছাত্রীর বদলে বিত্তবানতর কিন্তু দুর্বল মেধাযুক্ত ছাত্রছাত্রী পড়িতে আসে, তাহাও প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথা, এবং সংশোধনীয়। মোদ্দা কথা, সরকারি জ্যেষ্ঠতাতগিরি চলিবে না, শিক্ষার উত্কর্ষের নামেও চলিবে না, বেনামে ক্ষমতা প্রসারের কারণেও চলিবে না।
মন্ত্রকের আর একটি প্রস্তাব, আই আই এম-গুলি পিজিডিএম অর্থাত্ ডিপ্লোমা-র পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাফিক এম বি এ এবং ডক্টরেট-এর ডিগ্রি প্রদান করিবে। ইহাও অত্যন্ত আপত্তিকর। ম্যানেজমেন্ট পাঠক্রম যত উচ্চমানেরই হউক না কেন, সারস্বত মূল্যের নিরিখে তাহার অবস্থান নিম্ন। কোনও মৌলিক কলা বা বিজ্ঞান বিষয়ের যে সারস্বত গুরুত্ব, প্রায়োগিক জ্ঞানের সেই গুরুত্ব থাকিতেই পারে না। তাহাতে অসুবিধা নাই। কোনও কালে ছিলও না। পিজিডিএম লইয়াই আই আই এম-এর নক্ষত্ররা গত অর্ধশতকে অসামান্য যোগ্যতা দেখাইয়াছেন দেশেবিদেশে। আজও বহির্বিশ্বে ভারতের ছাত্রসম্পদের দৃষ্টান্ত হিসাবে একেবারে প্রথম সারিতে আই আই এম ডিপ্লোমাধারীদের গণ্য করা হয়। তাই, নামে কী-ই বা আসিয়া যায়! আসিয়া যায় কেবল সরকারি মন্ত্রীসান্ত্রিদের, যাঁহারা হাতে কাজ কম বলিয়া অকাজে মাতিতে ভালবাসেন। |