|
|
|
|
বাবার শুনানি চলছে, মেয়ে ব্যস্ত মোবাইল হাতে |
প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত • পানজিম
১ ডিসেম্বর
|
রবিবারের ময়রা গ্রাম। চেনা ছন্দে চলা, চেনা আলসেমিতে ঢাকা। সামনের মঙ্গলবারই সন্ত জেভিয়ার্সের পরব। তার ঠিক দু’দিন আগে, এই রবিবারের সকালে দল বেঁধে ছেলে-বুড়ো গির্জায় যাবে, সেটাই দস্তুর। তরুণ তেজপালের কী হল, পুলিশ তাঁকে হেফাজতে নিল কি না, ডোনা পাওলা ক্রাইম ব্রাঞ্চে বসিয়েই তাঁকে জেরা করা হবে, নাকি নিয়ে আসা হবে পুলিশের সদর দফতরে, পুলিশ চোদ্দো দিন হেফাজত দাবি করলেও বিচারক মাত্র ছ’দিন মঞ্জুর করেছেন, আর আপাতত তাতেই বেজায় খুশি তরুণের আইনজীবীরা টিভির সামনে বসে এই সব খবরাখবর সংগ্রহে ছুটির সকালটা মাটি করতে চান না ময়রা গ্রামের মানুষজন।
অথচ তরুণ তো তাঁদেরই এক জন। তিনি তো এই গ্রামেরই ‘বাসিন্দা’। হ্যাঁ, এই গ্রামেই তো একটা বাড়ি আছে তরুণ তেজপালের। এখানেই একটা বহু পুরনো পর্তুগিজ ভিলা কিনেছেন তিনি। তবে তেজপালকে সামনাসামনি কখনও দেখেনি এ গ্রাম। এখানে কবে তারকা-সাংবাদিকের পা পড়েছে, আদৌ পড়েছে কি না, সে কথা কেউ মনে করতে পারছে না। |
|
গ্রেফতারির পর গোয়া মেডিক্যাল কলেজে তহেলকার প্রাক্তন সম্পাদক। ছবি: পিটিআই। |
পুলিশের খপ্পরে পড়ে ‘পড়শি’র কী হাল, সে সম্পর্কে বাড়তি ঔৎসুক্য না থাকলেও একটা জিনিস ময়রা গ্রামের অনেককেই ভাবাচ্ছে। ধর্ষক তকমা, নাটুকে গ্রেফতার, খুনের মামলায় পাকড়াও দুই আসামির সঙ্গে লক আপে রাত্রিযাপন (লক আপে নাকি পাখাও নেই!) এত্ত সব কিছুর পরেও এত অবিচল থাকেন কী করে তেজপাল? নীল শার্ট, কালো ব্লেজার। ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল আর ঘাড়ের কাছে স্টাইলিশ পনিটেল। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা-র তো লেশমাত্র নেই কোথাও! আর শুধু তেজপালই বা কেন? তাঁর স্বজন-বন্ধুরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে এসেছেন, কারও চোখেমুখে তো উদ্বেগ প্রকট হচ্ছে না। ময়রার গ্রামবাসীদের মনে তাই এক ঝাঁক প্রশ্ন সমাজের উপরতলার এই মানুষগুলো কি অন্য ধাতুতে গড়া? বাবা ধর্ষণের মামলায় ফেঁসেছে,
আর মেয়ে আদালত চত্বরেই মোবাইলে কুটুর-কাটুর করছে, এ কেমন ধারা ব্যাপার-স্যাপার? একেই কি
বলে ‘লৌহকঠিন’?
ময়রা গ্রামেরই গ্যারাজ-মালিক ভিনসেন্ট কোয়েলো। তাঁর মাথাতেও একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে “আমাদের মতো সাধারণ মানুষের গায়ে কালির ছিটে লাগলে আমরা কাঁটা হয়ে থাকি। লোকসমাজে মুখ দেখাতেই লজ্জা পাই। আর এঁদের দেখুন!” ভিনসেন্টের পাশ থেকে বন্ধু বলে ওঠেন, “বড় বড় ঘরের বড়সড় ব্যাপার। পরিস্থিতি সামাল দিতে এরা পাকাপোক্ত। আর আদালত-মামলা, এ সব তো তেজপালের চেনা গলিঘুঁজি। কম স্টিং অপারেশন তো করেনি!” মনোবিদেরাও ভিনসেন্টদের সঙ্গে একমত। এক মনোবিদের কথায়, “ওঁরা সমাজের যে স্তরের মানুষ, তাতে চট করে ভয় বা আতঙ্কে ভোগেন না। আরুষি তলবারের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছে।”
রবিবার সকালে তখনও তেজপালকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়নি। দায়রা আদালতে তত ক্ষণে হাজির হয়েছেন তরুণের আত্মীয়েরা। শুনানির সময়ে সংবাদমাধ্যমকে আদালত কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এই ঘোষণা হওয়া মাত্র হইচই শুরু হয়ে যায়। জানা যায়, তেজপালের আত্মীয়দেরও ভিতরে ঢোকা বারণ। এই সঙ্কটের মুহূর্তে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে আরও দুশ্চিন্তা বেড়ে যাবে না? সাংবাদিকের এই প্রশ্নে ঈষৎ আশ্চর্য তরুণের ভাই মিন্টি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “কই? না তো। আমাদের কোনও চাপ নেই।”
তারা যে চাপে নেই, তেজপাল পরিবার তা তাদের প্রত্যেকটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। গোয়া থেকে তরুণের এক বন্ধু এসেছেন। আদালত চত্বর সরগরম তাঁর রোদচশমা পরার ধরন দেখে। নাকের উপরে নয়, চকচকে টাকের পিছন দিকে, কী যেন কায়দায়, সানগ্লাস আটকে রেখেছেন তিনি। কত বার ব্যস্তসমস্ত হয়ে আদালত থেকে ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন, কিন্তু তাঁর সানগ্লাস এক চুলও নড়ছে না। তাঁর আদবকায়দার সামনে তো ‘দবং’-এর চুলবুল পাণ্ডের ঘাড়ে সাঁটা সানগ্লাসও ম্লান! নিকটাত্মীয়ের মামলা শুনতে এসেছেন, না আইপিএল দেখতে, তেজপালদের দেখে বোঝারউপায় নেই। দেড় লিটারের ঠান্ডা পানীয়ের বোতল ঘুরছে হাতে হাতে। প্রত্যেকেই ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে। মেসেজ পাঠাতে, নাকি ফেসবুক করতে? এমনকী, বিচারক যখন চার ঘণ্টা বাদে এলেন এবং তরুণের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দিলেন, তখনও আত্মীয়বন্ধুদের বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়তে দেখা গেল না।
কী বলছেন মনোবিদেরা? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বললেন, “পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে বলেই তেজপালকে ধরেছে। তরুণ ও তাঁর পরিবারের আচরণ থেকে মনে হচ্ছে, অপরাধের ভীতি চোখেমুখে ফুটিয়ে তাঁরা পুলিশের প্রমাণে ইন্ধন জোগাতে চাইছেন না। তাই মুখের স্বাভাবিক ভাবটাই তাঁদের ধরে রাখতে হচ্ছে।”
তবে শুধু তরুণ বা তাঁর পরিবার নয়। তরুণকে জেরা করছেন যে অফিসার, অবিচল সেই সুনীতা সবন্তও। আজ পাঁচ ঘণ্টা জেরা করা হয় তেজপালকে। কালও সকাল থেকে জেরা-পর্ব শুরু হয়ে যাবে। এই কেসের দায়িত্ব পাওয়া ইস্তক তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোনোর সুযোগ পাচ্ছেন না। কিন্তু রংচঙে সালোয়ার কুর্তা আর ম্যাচিং কানের দুলে সুনীতাও আজ টিপটপ। কী ভাবে এত টেনশন-মুক্ত রাখেন নিজেকে? “অফিসের চাপটা অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যেই রেখে যাই, সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাই না” মুচকি হেসে কোর্টে ঢুকে গেলেন দুঁদে পুলিশ অফিসার। |
পুরনো খবর: আগাম জামিনের আর্জি খারিজ, হেফাজতে তরুণ |
|
|
|
|
|