রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জা স্ট যা চ্ছি
চ্ছে করে চোখ বন্ধ করে থাকলে অনেক কিছু বোঝা যায়। রাবারের চপ্পল পরে হাঁটছি বালির ওপর দিয়ে। প্রতি পদক্ষেপে বুঝতে পারছি চলেছি ঠিক কোনখান দিয়ে। প্রথমে কয়েক সেকেন্ড, তার পর মিনিটখানেক চোখ বন্ধ করে হেঁটে গেলেও আর অসুবিধে হচ্ছিল না। পা যদি বসে যেতে চায় শুকনো, ভুসভুসে বালিতে, তা হলে বোঝা যাচ্ছে জল রয়েছে কিছুটা দূরে। আন্দাজ করতে পারি, চমৎকার ছাপ পড়ছে বালিতে। একটু বেশি ভিজে হলেও স্পষ্ট বুঝতে পারি এখানে জলের আসা-যাওয়া রয়েছে, চোখ বোজা অবস্থাতেও দেখতে পাই জল ফিরে গেলে ছোট ছোট নিশ্বাসের বুদ্বুদ বেরোচ্ছে সেখান থেকে। এর সঙ্গে রয়েছে ক্রমাগত জলের শব্দ। জোয়ার এসেছে বোধহয়। কিছু দূরে ঢেউ ভাঙছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন একটু ড্রাম বাজিয়ে নিল। ঢেউ ভেঙে গেলে জলের তর সয় না। তাড়াহুড়ো করে দৌড়য় তীরের দিকে, বেহিসেবি ফেনায়, অকারণ বুদবুদে মিশে যাওয়ার খেলায়। এরও শব্দ আছে, হালকা সিমবালের মতো। পায়ের পাতা ভিজে যেতেই থমকে দাঁড়াই। ঠান্ডা নোনা জলে জ্বালা করে ওঠে নতুন ফোসকাটা, চোখ খুলে ফেলি।
একটা নারকেল গাছ, দু’খানা নৌকো আর খানচারেক বাড়িভরা গ্রাম। নাম কোনাডা। ওখান থেকেই হাঁটতে শুরু করেছি কয়েক দিন আগে। দু’দিন পরে বিশাখাপত্তনমের বিচে নামিনি। শহরের মধ্যে দিয়ে ঘুরে, জাহাজ বন্দরকে বাইপাস করে, বেশ কিছুটা উঠে আবার নেমে এসেছি বালিতে। আর শহর দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি, অটোর আওয়াজও কানে আসছে না। শুধু হাওয়ার শব্দ। ছোট বড় পাথর আর পাহাড় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বালির ওপর। ওই রানওয়েতে নামব আমরা। ছোট টিলা, বিচ আর সমুদ্র, অন্ধ্রপ্রদেশের একটা টিপিকাল চেহারা। এসেছি কোস্টাল ট্রেক করতে। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত হাঁটা। কখনও সমুদ্রে হুটোপুটি, কাঁকড়াকে তাড়া করে ছবি তোলার চেষ্টা। গ্রাম আছে আশেপাশে, সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরে, গাছপালার আড়ালে। রোদ পোহানো নৌকো আর গা শুকোনো জাল দেখলে বুঝতে পারি সেটা। কখনও অনেক দূরের একটা কালো বিন্দু হঠাৎ কাছে এসে পড়ে। সঙ্গে তার প্রচুর মাছ, সদ্য ধরেছে। দাম জিজ্ঞেস করি। ভাষা বোঝে না। একটা বড় মাছ হাতে ধরিয়ে দিয়ে, একটু হেসে আবার বিন্দু হয়ে যায়। রাতে থাকি মন্দিরের চাতালে, স্কুলবাড়িতে অথবা সাইক্লোন সেন্টারে।
তারায় ভরা আকাশের নীচে বালিয়াড়ির ওপর রতনদা চুপচাপ বসে ছিলেন সমুদ্রের দিকে মুখ করে। অদৃশ্য দিগন্তে একটা-দুটো জাহাজের আলো সরছে ধীরে ধীরে। বললাম, ‘পাহাড়ের ট্রেকে কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার অনেক বেশি, যা-ই বলুন।’ রতনদা বললেন, ‘ঘটনার অভাব হয় না। যেখানে মানুষ থাকে, সেখানেই কিছু না কিছু ঘটে যায়।’ শুনলাম। কিছু বললাম না। গতকালই একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। গ্রামে ঢুকেছিলাম একটু বাজার করতে। একটাই দোকান, সবজিও পাওয়া যায়, জুতোও আছে। হইহই করে টোম্যাটো আর চিনি কিনে ফেললাম। চাটনি করা যাবে। আদা চাইলাম। এটা দেয়, সেটা দেখায়। মরিয়া হয়ে, ‘অদ্রক! অদ্রক!’ বলে হাত-পা নেড়ে বোঝালাম। এক বুড়ো সব শুনছিল।
ছবি: শুভময় মিত্র।
ইশারায় বোঝাল, সে বুঝতে পেরেছে। দোকান থেকে একটা আধ কিলোর বাটখারা তুলে আমার হাতে দিয়ে হাসল। সর্বনাশ! শুনেছে ‘আধা’। একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ছিল প্রায় প্রত্যেক গ্রামে। ইলেকট্রিকের তার রয়েছে, কিন্তু হ্যারিকেন জ্বলছে সব জায়গায়। তার পর আবিষ্কার হল, একটাই বাড়িতে বাল্ব জ্বলছে, বেশ রংচং করা সম্পন্ন চেহারা, মদের দোকান।
পাহাড়ে চড়তে গেলে প্রাপ্তি যেমন থাকে, তেমনি অতর্কিত চ্যালেঞ্জও মাথা তুলে দাঁড়ায় নোটিস না দিয়ে। সমুদ্রের তীরে ও-সব নেই। শুধু উপহার আর উপহার। গঙ্গাভরমের পাহাড়টা ফুরোতেই আর একটা পাহাড়। মাঝখানে ছোট্ট নীল সমুদ্রের টুকরো। দেখামাত্র দৌড়লাম সবাই। তার পর জল থেকে আর ওঠার নামগন্ধ নেই। অসিতদা বয়স্ক মানুষ, তাই রগড় করা হল কিছু ক্ষণ। ‘লাল পোলকা ডটওয়ালা টু পিস বিকিনি পরা মেয়ে থাকলে সিনটা কমপ্লিট হত আপনার জন্য।’ রসিকতাটা বাড়াবাড়ির দিকে যেতেই তাতে জল ঢেলে দিলেন রতনদা। ‘মাছ ভাজা হয়ে গেছে, উঠে এসো, উঠে এসো।’
পুডি মাডাকা এসে গেছে বুঝতে পেরেছিলাম কিছুটা আন্দাজে। অনেকটাই সমুদ্রে সাদা আর হলুদ বিন্দু দেখতে পেয়ে। মাছ ধরার নৌকো, অজস্র, পাল তুলে ফিরছে। তীরের কাছে পৌঁছেই ঝপাঝপ পাল নামিয়ে লোকজন নেমে পড়ছে জলে। সমুদ্র চাইছে কালো নৌকোগুলোকে আবার সমুদ্রে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আরও কালো মানুষগুলো জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের এনে ফেলছে তীরে। তার পরেই মাছের বাজার। ফড়ে, দালাল, নিলাম। আমাদের সবার হাতে ঝুলছে ঝকমকে রুপোলি মাছ। আমি ঘোষণা করলাম, ‘আজ আর বেশি হাঁটব না। কারণ, এত মাছ ভাজতে হবে, খেতে হবে, সময় লাগবে।’ রেভুপোলাভরম পৌঁছে চোখে পড়ল ছোট টিলা। ওপরে সাদা রঙের মন্দির। ওখানেই থাকা যাবে রাতে, আর সমুদ্র দেখা যাবে অনেকটা উপর থেকে।
রাতের আস্তানা ঠিক করার ক্ষেত্রে একটাই মাথা দেওয়ার ব্যাপার থাকে পানীয় জল চাই। বালির মধ্যেও দিব্যি জল ওঠে টিউবওয়েল থেকে। এ ছাড়া কুয়ো পেয়ে গেলে একশো মজা। চান করা যায় মিষ্টি জলে। সারা দিন ধরে চামড়া পোড়ানো নোনা রোদ্দুরে জ্বলা শরীরটা জুড়িয়ে যায় দু’মিনিটে। পাওয়া গেল কুয়ো। জোগাড় হল দড়ি লাগানো বালতি। হাফপ্যান্ট পরা আমরা জনা ছয়েক বেটাছেলে এগোলাম সে দিকে। এক দল পালা করে জল তুলবে। কেউ ঢালবে হুড়মুড় করে। যার ওপর ঢালা হবে, সে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে মাটিতে। সবচেয়ে সিনিয়র, তাই প্রথমেই অসিতদার টার্ন। হয়ে গেলেই তাঁর ছুটি, তাঁর আর জল তুলে পরিশ্রম করে কাজ নেই। সন্ধে নেমে গেছে অনেক ক্ষণ, কিন্তু চোখ সয়ে যাওয়ায় দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না।
শরীরে প্রথমে ঠান্ডা জলটা লাগতেই গান ধরে ফেললেন অসিতদা। এই গান গাওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সবই দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান। রেকর্ডে ঠিক যেমন পর পর যে যে গান আছে, গাওয়াও হবে সেই অর্ডারে। চলল লম্বা চান, সাবান মেখে। ছ’টা গান হতেই কে যেন বলল, ‘রেকর্ড উলটে দে এ বারে।’ কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছিল আমাদের কারা যেন দেখছে, চাপা গলার শব্দ শুনলাম যেন, মেয়েদের গলা। আশেপাশে টর্চ ফেলতেই পায়ের শব্দ বালিয়াড়ির ওপর। বোধহয় গ্রামের মেয়েরা এসেছিল কুয়ো থেকে জল নিতে, আমাদের ওই অবস্থায় দেখে আর এগোয়নি। আমরা একটু তাড়াতাড়ি চান সেরে কেটে পড়লাম মন্দিরের দিকে, ওদের দাঁড় করিয়ে রাখাটা ঠিক নয়। তা ছাড়া খিদেও পেয়েছিল খুব।
প্রত্যেক দিনই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ি, রোদ চড়া হওয়ার আগে যতটা এগিয়ে যাওয়া যায় আর কী। বাঁধা ব্রেকফাস্ট হল চা আর সুজি। আজ সকালের পথে অনেক দূর টানা যেতে হবে। এই রাস্তায় জল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই জেরিক্যান নিয়ে এগোলাম কুয়োর দিকে। ‘গ্রামের মেয়েরা আসবে নিশ্চয়ই, এক বার রিভাইস করে নেবে তো? সকালের প্রথম আলোয় ওদের কিন্তু ফরসা লাগে’ এই সব কথা বেশি এগোল না, কারণ প্রচুর মেয়ে সেখানে ভিড় করে আছে। আমাদের দেখে ওরা জায়গা ছেড়ে দিল। জল তুলে ভরে দিল জেরিক্যানে। খুব হাসছিল সবাই। নিজেদের ভাষায় কত কী বলে যাচ্ছিল। হাসির কারণটা বোঝা সহজ। আমাদের মতো উন্মাদ ওরা নিশ্চয়ই দেখেনি আগে, যারা অকারণে রোদে-জলে হাঁটতে আসে। আমরা চলে যাবার একটু পরে শুনলাম ওরা গান ধরেছে নিজেদের ভাষায়। বেশ কিছুটা চলে আসায় অস্পষ্ট হয়ে আসছিল ওদের গানটা। সুরটা খুব চেনা চেনা। ভাল করে শুনলাম কান পেতে। সমুদ্রের শব্দের মধ্যেও পরিষ্কার চিনতে পারলাম সুরটা ‘সুনীল সাগরের, শ্যামল কিনারে।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.