এ বছর রথযাত্রা চলে গেল, কিন্তু খবরকাগজে দেখা গেল না ‘বিশেষ’ একটা জিনিস। অথচ, সে এক দিন ছিল, যখন রথের তারিখে কাগজ হয়ে উঠত বিশাল মোটা। মূল কাগজ যদি ১৬ পাতার, সঙ্গে ক্রোড়পত্রটি ২৪ পাতার! ঢাউস ঢাউস ফুল-পেজ অ্যাড। সে সব জুড়ে নায়ক-নায়িকাদের পমেটম-মাখা মুখ। কাজলটানা চোখ। সে সব দিনে রথযাত্রা উপলক্ষে চিৎপুর হয়ে উঠত যেন জগদ্ধাত্রী পুজোর চন্দননগর। অলিতে-গলিতে মন্ডা-মেঠাইয়ের গন্ধ। অপেরার গদিতে গদিতে অধিকারীরা ধোপদুরস্ত হয়ে বসে। অসম, ত্রিপুরা কিংবা এ রাজ্যের জেলাগুলি থেকে আসবেন কত লোক। যাত্রাপালার বায়না করতে। এ বার রথের দিনে চিৎপুর দেখল না ভিড়ভাট্টা। দেখল না উৎসবের আমেজ। ১৯৭০-’৮০-র দশকের সঙ্গে এই পরিবেশের কোনও তুলনাই হয় না। কেন? নয়নতারা অপেরার মালিক প্রশান্ত গোস্বামী বললেন, ‘মিছিমিছি কেন তুলনা টানছেন? তখন কি ডজন ডজন টিভি চ্যানেল ছিল? শয়ে শয়ে সিরিয়াল ছিল? রিয়েলিটি শো ছিল? দাদাগিরি, দিদিগিরি হাবিজাবি ছিল? কার ঘরে টিভি নেই বলুন তো? কে দেখতে পায় না সুইচ অন করলেই রণবীর কপুর কিংবা ক্যাটরিনা কাইফকে? বিনোদনের হাজারও পসরা নিয়ে টেলিভিশন যখন হাজির সুন্দরবনেও, তখন আর কে দেখবে যাত্রা? আসলে কি জানেন, বোকাবাক্সের পরদার চ্যালেঞ্জকে কী ভাবে রোখা যাবে, তা চিৎপুর বুঝে উঠতে পারল না।’
প্রশান্তর অভিযোগ পুরোপুরি মানেন না নটরাজ অপেরার হিরো ত্রিদিব ঘোষ। ‘চ্যালেঞ্জে কুপোকাত কি শুধু যাত্রা? চিৎপুরের পাশের পাড়া হাতিবাগানের কী হাল? রঙ্গনা কিংবা সারকারিনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার মনে হবে ওগুলো যেন পোড়ো বাড়ি। অথচ এক সময় বৃহস্পতি, শনি কিংবা রবিবার বিকেলবেলা ও সব হলের সামনেটা শালি-জামাইবাবুদের কলতানিতে মুখর হয়ে উঠত। আজ শালি আছে, জামাইবাবুও আছে, নেই রাসবিহারী সরকারের ‘সম্রাট ও সুন্দরী’। নেই মিস শেফালির নাচ। যাত্রাও সংকটে পড়েছে একাধিক কারণে। ভাল কাহিনি নেই, ভাল পরিচালক নেই, ভাল অভিনেতা নেই। খেয়াল করে দেখুন, সবই আছে সিনেমা, সিরিয়ালে। বিনোদন মানে রসায়ন, রান্না। যাত্রা এখন মালমশলার অনটনে পড়ে বিস্বাদ রান্না হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী বলব মশাই, যাত্রাপালায় গান এখন একটা হাস্যকর উপাদান। পুরনো দিনে এক একটা পালায় থাকত বিশ-বাইশটা গান। সেগুলো লেখা হত শুধু যাত্রার জন্যই। গাওয়াও হত কাহিনির খাতিরে। আর এখন যাত্রার জন্যে আলাদা গান লেখার বদলে অনেক সময়েই থাকে সুপারহিট হিন্দি অথবা বাংলা সিনেমার মারকাটারি গান। তো সে সব গাইবে কে? নাহ্, পুরনো দিনের মত নায়ক-নায়িকা নয়। ডায়ালগের মাঝখানে হঠাৎ বাজবে টেপরেকর্ডার। চলবে গান। নায়ক-নায়িকা শুধু ঠোঁট নাড়বেন। বুঝুন অবস্থা! ধার করা অক্সিজেনে কত দিন বাঁচা যায়?’
ত্রিদিবের কথা হয়তো ঠিক। সত্তরের দশকে রমরমিয়ে বিক্রি হত সুপারহিট যাত্রাপালার এলপি রেকর্ড। এখন যাত্রার বাজার নেই বলে বেরোয় না তার সিডি। অথচ ‘সোনাইদিঘি’ কিংবা ‘নটী বিনোদিনী’র এলপি এক সময় বিক্রি হত ‘শোলে’র এলপি-র পাশাপাশি, পাল্লা দিয়ে। |
এই মরা কটালের যুগে একদম ব্যতিক্রম নেই তা নয়। অনল চক্রবর্তী-কাকলি চৌধুরী এই মুহূর্তে যাত্রার উত্তম-সুচিত্রা। ওঁদের পালা নাকি ফ্লপ হয় না। কলকাতায় যাত্রা উৎসবেও ওঁদের শো হাউসফুল। অনল আবার আওড়ান না অন্যের লেখা সংলাপ। পালার কাহিনিকার তিনি। পরিচালকও তিনি। কেন? জবাবে অনল শোনান এক কাহিনি। বছর দশেক আগে, গাঁয়ের মাঠে বসেছে আসর। এগিয়েছে কয়েক সিন। নায়ক অনল গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ডায়ালগ। হঠাৎ থার্ড রো-এ বসে এক ছোকরা হাত উচিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বেশ বেশ অনলদা। দারুণ হচ্ছে। এর পরে তো রাজা হিন্দুস্তানি? বুঝে গেছি।’ কোনও রকমে পালা শেষ করে সাজঘরে মাথা হেঁট করে বসে পড়েছিলেন অনল। ‘যুবকটি আমাকে নয়, গালে চড় মেরেছিল বাংলার যাত্রাশিল্পকেই। সে রাতে ধিক্কার দিচ্ছিলাম আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে। ভাবছিলাম, আমাদের পালার কাহিনি যা, তা তো সত্যিই বলিউডের ফিল্ম ‘রাজা হিন্দুস্থানি’র টুকলি। ছেলেটির কী দোষ? পালার কাহিনি যদি হয় চোরাই মাল, খদ্দের তা কিনবে কেন?’ সে রাতেই অনল ঠিক করেন, চিৎপুরে থাকুন যতই স্বঘোষিত সেলিম-জাভেদ, তাঁদের লেখা পালায় আর অভিনয় করবেন না তিনি। নিজেই লিখবেন কাহিনি। পরিচালনাও করবেন।
সেই ইচ্ছারই এক ফসল ‘সেদিন ঠিকানা হারিয়ে’। গল্প মিলনান্তক নয়। বরং ট্র্যাজিক। শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা যখন বসবে বিয়ের পিঁড়িতে, তখন ফাঁস হয় এক মর্মান্তিক সত্য। ওরা ভাই-বোন। অতঃপর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু দু’জনের। এ কেমন পালা? ইচ্ছেপূরণ নেই, ফর্মুলা স্টোরি নয়। জার্ক বলে জার্ক! সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এ পালা হিট। কেন? প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন অনল। বললেন, ‘খবর রাখেন কি, গত তিন-চার দশকে মানুষের মন কতটা বদলে গেছে? গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন ফেসবুক করে। সস্তা কমেডি কিংবা জগঝম্পে ওরা আজ আর খুশি হতে পারে না।’
‘বিশেষ কোনও যাত্রা কোম্পানি কিংবা বিশেষ কোনও হিরো-হিরোইনের সাফল্যে বিভ্রান্ত হবেন না’, বললেন মঞ্জরী অপেরার নেপাল সরকার, ‘যাত্রাশিল্পের আয়ু আর বড় জোর কয়েক বছর। তার পর একে একে ঝাঁপ বন্ধ করবেন অনেক মালিক, ম্যানেজার। ডাউনফল শুরু হয়েছে অনেক দিন। চিৎপুরে ১০ বছর আগে যাত্রা কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৩৬। গত বছরেও ছিল ৬১টা। এ বার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮-এ। আমার মনে হয়, সামনের বছর যাত্রাদলের সংখ্যা হবে ২৫।’
বাংলার জল-মাটির আপন ঐতিহ্যে গড়া যে বিনোদন শিল্প, সেই যাত্রা নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে চলেছেন প্রভাত দাস। যাত্রা বাঁচবে? প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন প্রভাত। বললেন, ‘কী করে বাঁচবে বলুন? অন্ধকার রাতে বিশাল প্যান্ডেলের মধ্যে শয়ে শয়ে মানুষকে বসিয়ে রাখার মত গল্প কোথায়? মন মাতানো গল্প লেখার লোক কোথায়? একদা তেমন শক্তিশালী কলম নিয়ে ময়দানে এসেছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে। তাঁর উত্তরসূরি যদি কেউ হন, তিনি ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর? না, তেমন শক্তিশালী আর কেউ এলেন না। যাঁরা এলেন তাঁরা উপহার দিলেন কিছু নাচ-গান, হইহুল্লোড়। ব্যস, ওই দিয়েই ভাবলেন, বেশ সমসাময়িক করে তোলা গেল যাত্রাকে। ঘণ্টা! মানুষ শুনতে চায় গল্প। চরিত্র কিংবা আদর্শের সংঘাত। কেবল কিছু মানুষের স্টেজে হাঁটাচলা দিয়ে কিস্যু হবে না।’
মহাভারতে ভীষ্ম চোখের সামনে তিলে তিলে ক্ষয়ে যেতে দেখেছিলেন আস্ত এক রাজবংশ। বাঙালির যাত্রা শিল্পেও আছেন এক ভীষ্ম। ইন্ডাস্ট্রি তাঁর নাম দিয়েছে ‘বড়দা’। বড় ভাই নয়, প্রপিতামহ বলা যায় তাঁকে। বয়স ৮৩। তিনি মাখনলাল নট্ট। ঠিকানা শোভাবাজার। হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট। থাকেন যে বাড়িখানায়, তার বয়স সওয়াশো বছর, খসে পড়েছে পলস্তারা। সিঁড়িতে আলো নেই, দিনের বেলাতেই ঝুঁঝকো আঁধার। পা টিপে প্রায় হাতড়ে তিনতলায় উঠতে হল ভীষ্মের দেখা পেতে। ফোন করা ছিল। পৌঁছতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নট্ট কোম্পানির মাখনলাল। কী জানতে চাই, তা শুনে চোখের দিকে সোজা তাকালেন।
বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাত্রার বাঁচার আশা নেই।’ বলছেন একটা শিল্প নিয়ে। কিন্তু কণ্ঠস্বরে আবেগ শুনে মনে হল যেন নার্সিংহোমে আইসিইউ-তে শয়ান আত্মীয়ের খবর দিচ্ছেন। মাখনলাল দায়ী করলেন যাত্রা কোম্পানির মালিকদের। বললেন, ‘অব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসা পড়লে ফল যা হয়, তা-ই হয়েছে। মালিকরা ধরে ধরে আনছেন টিভি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের। কই, যাত্রার হিরো-হিরোইনদের তো সিরিয়ালওয়ালারা ডাকছেন না! যাত্রা-মালিকরা টিভির হ্যাংলামি ছাড়বেন না, তাই যাত্রাও আর বাঁচবে না।’
যাত্রাকে তা হলে বাঁচাবে কে? পুঁজি? একটু-আধটু হলেও, যাত্রা-পুনরুজ্জীবনে সহযোগিতার হাত কিন্তু বাড়িয়েছিল ব্যবসা সাম্রাজ্য। মাল্টিন্যাশনাল। তাঁদের প্ররোচনায় যাত্রার সংলাপে গুঁজে দেওয়া হচ্ছিল ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। কী ভাবে? ধরা যাক, বৃদ্ধ স্বামী নিরুদ্দেশ। অনেক দিন পরে ঘরে ফিরলেন তিনি। তাঁকে দেখে ছুটে এলেন স্ত্রী। ‘ওগো কোথায় ছিলে?’ স্বামীর উত্তর, ‘সে অনেক কথা, পরে বলছি, আগে জল দাও।’ শুনে স্ত্রীর জবাব, ‘জল খাবে কেন গো, তোমার জন্য অমুক কোল্ড ড্রিংক আনছি!’ বা, বাচ্চা ছেলে অসুস্থ। তার মা স্বামীর উদ্দেশে বললেন, ‘ছেলিডারে এট্টু তমুক এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানি লাগে। তা পাই কই?’ দরিদ্র স্বামী অনেক কষ্টে জোগাড় করে আনেন বলবর্ধক পানীয়টি এবং সারা স্টেজ ঘুরে স্ত্রীকে দেখাতে থাকেন। স্পটলাইটের আলো পড়ে বোতলের গায়ে ব্র্যান্ডের উপর। অবশ্য, বেশি দিন এগোয়নি এই ব্যবস্থা। মরা গাঙে যে আর কখনও বান আসবে না, সেটা বুঝে গিয়ে ব্র্যান্ড মালিকরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন যাত্রা থেকে।
এখন কোনও আশ্চর্য নতুন এনার্জি ড্রিংক যাত্রাকে আবার চনমনে করে তুলবে, সে আশা কারও নেই। বাঙালির আদরের এক শিল্প, অতএব, এখন দাঁড়িয়ে লাস্ট সিনে।
যবনিকার অপেক্ষায়। |