ভাল আর মন্দ
টুম্পা, টাবলুর দাদু ত্রিলোচন চক্রবর্তী রিচি রোডে তাঁর মেয়ের নতুন বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। বাগানওলা দোতলা বাড়ি ঘুরে দেখার পর টুম্পাদের ঘরে তিন জনের গল্পের আসর বসেছে। বারো বছরের টাবলু বলল, ‘জানো তো দাদু এ বাড়িতে একটা ভূত আছে এক এক দিন সে মাঝরাত্তিরে দেখা দেয়।
‘অ্যাঁ!’ দাদু চমকে ওঠেন। দাদুর দুটো জিনিসে ভয়। এক শীত, দুই ভূত। সেই পয়লা নভেম্বর থেকেই দাদুর মাথায় টুপি, পায়ে মোজা।
ভূত আছে বটে। টাবলু দাদুর কোলে চড়াও হয়ে বলে, তবে ভূতটা বেশ ভাল। মানে, আমি যদি রাতে ব্রাশ না করে শুয়ে পড়ি, তা হলে সে রাত বারোটার সময় এসে বলবে, ‘আজ দাঁত না মেজে শুয়ে পড়লে যে বড়।’
আমি ধড়মড় করে উঠতে যাব, সে বলে, ‘থাক, এখন আর ব্যস্ত হতে হবে না। কাল সকালে মেজে নিলেই হবে।’
দাদু বলে, ‘ভাল ভূতও আছে তবে।’
আছে বইকী, টাবলুর তিন বছরের বড় দিদি টুম্পা বলে, এ বাড়ির যিনি কেয়ারটেকার সেই হাবলুবাবু বলেন, ‘ভাল ভূত আছে, মন্দও।’ বাবা যখন এ বাড়ি কেনা ঠিক করে তখন তারা কেমন করে তা জানতে পারে। মন্দ ভূতটা ভালকে বলে, ‘চল, আমরা এখান থেকে সরে পড়ি। নতুন যারা আসছে তারা কেমন লোক হয় কে জানে!’
ভাল বলে, ‘আমার এ জায়গাটার ওপর ভারী মায়া পড়ে গিয়েছে রে! এখানে সকালে কোকিল ডাকে, সন্ধ্যায় শাঁখ বাজে কাছের মন্দিরে। আমার ইচ্ছে করে যে ক’দিন বাঁচি, এখানেই কাটিয়ে দিই দুগ্গা বলে।’
‘তবে তুমি থাকো, আমি যাই’, বলে হুশ করে উধাও হয় মন্দ ভূত! সঙ্গে সঙ্গে শিরীষ গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ে নীচে। ভূতেদের নাকি এই নিয়ম, যেখান থেকে চলে যায় সেখানে রেখে যায় একটা চিহ্ন।
এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বাড়িতে এসে যায় টুম্পা, টাবলুরা। তাদের বাবা ডাক্তার, মা স্কুলে আঁকা শেখায়, ওরা ভাইবোন স্কুলে পড়া ছাড়া টাবলু টেবিল টেনিস খেলে দারুণ। টুম্পা পিয়ানো শেখে। চার জনই ভয়ানক ব্যস্ত। যেমন কাজ করে মন দিয়ে, তেমনি মজাও করে প্রাণভরে। এক দিন ওই রকম রাতে ডিভিডিতে ‘গু গা বা বা’ দেখতে গিয়ে টুম্পার খেয়াল নেই তার হোমটাস্ক করা বাকি রয়ে গিয়েছে।
রাতে ঝিরিঝিরি বাতাস দিচ্ছে। শিরীষ গাছের পাতা কাঁপচ্ছে, এমন সময় টুম্পার মনে হয় তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কে যেন বলছে, ‘রায়মশায়ের ছবি দেখে তো খুব মজা করলে কাল প্রথম ক্লাসটা যে মিস ফিনলের সেটা মনে আছে?’
কেন মনে থাকবে না। টুম্পা হাসে। মিস ফিনলের ক্লাস করতে তো আমার খুব ভাল লাগে। উনিও আমায় স্নেহ করেন...
তা করেন জানি, ভাল ভূত বলে, কিন্তু বলছিলুম ইংরেজি রচনাটা যে উনি বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে যেতে বলেছিলেন সেটা বোধ হয়...
টুম্পা তড়াক করে উঠে বসে। মনে পড়েছে রচনাটার নাম, ‘দ্য স্কাই অ্যাবাভ’। তখুনি টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে লিখতে বসে যায় সে। প্রথমে একটা খসড়া পড়ে সেটা ঘষে মেজে দাঁড় করাতে রাত গভীর হয়।
পর দিন প্রথম পিরিয়ডে সে রচনা পড়ে মিস ফিনলে টুম্পার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন!
ছবি: সুমিত্র বসাক।
মিস ফিনলে টুম্পার এক জন প্রিয় শিক্ষক। আস্তে কথা বলেন। শেলি বা ডিকেন্সের লেখা এমন করে বুঝিয়ে দেন যে, তাঁদের আরও বই পড়তে ইচ্ছে করে।
আর একটা কারণে মিসকে টুম্পার ভাল লাগে, তা হল তার আর এক প্রিয় মানুষ রুণুমাসির সঙ্গে তাঁর মিল। রুণুমাসি টুম্পারা আগে যেখানে থাকত, সেই কেয়াতলায় তাদের বাড়ির এক তলায় থাকেন। দু’জনের মাথাতেই কাঁচাপাকা চুল। রুণুমাসিরও মিস ফিনলের মতো আত্মীয় বলতে কেউ নেই। এক জন ইংরেজি পড়ান, এক জন গান শেখান ‘রবিকরে’। মিস ফিনলের পোষ্য একটি কুকুর, নাম ‘কলম্বাস’। রুণুমাসির আছে দু’টি বেড়ালছানা, উঁকি আর ঝুঁকি। রিচি রোডে চলে আসায় টুম্পার এক বড় দুঃখ, রুণুমাসির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া।
তবু মাসি ভাল আছে, কিন্তু মিস ফিনলের এখন খুব বিপদ। তাঁর বাড়িওলা তাঁকে তাঁর এক তলা থেকে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ওখানে তিনি পাঁউরুটির দোকান দেবেন। পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড় কি না টুম্পা জানে না, কিন্তু কথাটা শোনা পর্যন্ত টুম্পার মন খুব খারাপ।
‘ভাল একটা কিছু করো’। রাতে শুতে যাওয়ার আগে শিরীষ গাছের দিকে তাকিয়ে টুম্পা বলে, ‘এই বয়সে তিনি কোথায় যাবেন!’
শিরীষ গাছের ডাল নড়ে ওঠে, কে যেন বলে, ‘দেখি কী করা যায়! একার দ্বারা হবে না। মন্দর মদত নিতে হবে মনে হয়।’
পরের দিনই ঘটনাটা ঘটে।
বাষট্টি বছরের সুবল সমাদ্দার মেয়ের বিয়ের খরচ বাবাদ ব্যাঙ্ক থেকে সত্তর হাজার টাকা তুলে বাড়ির পথ ধরেছেন। সমাদ্দার মশায়ের মাথায় ছাতা, বগলে টাকা ভর্তি ব্যাগ। ঠিক তিন মাথার মোড়টা পেরোতে যাবেন, এমন সময় লিকলিকে চেহারার এক ছোকরা কোত্থেকে এসে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে দে দৌড়। সমাদ্দারমশাই এমন হকচকিয়ে গেছেন যে, চেঁচিয়ে ‘চোর’ বলতেও গলার আওয়াজ ফোটে না তাঁর।
হঠাৎ কোত্থেকে একটা পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে এসে থামে ঠিক ‘লিকলিকে’র সামনে। সে তাতে হোঁচট খেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে মাটিতে। ঠিক তখনই এক জন ভদ্রসভ্য চেহারার বালক তার সামনে এসে বলে, ‘লজ্জা করে না এক জন বৃদ্ধের তিলতিল করে জমানো টাকা এই ভাবে চুরি করতে...।’ সুবলবাবু ততক্ষণে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেখানে এসে গিয়েছেন। বালক ব্যাগ তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নিন দাদু, আপনার ব্যাগ। আপনি তো কাছেই থাকেন। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়’, সমাদ্দার বিগলিত হয়ে বলেন। তাঁর মনে হয় স্বয়ং দেবদূত তাঁর হাত ধরে আছেন। বাড়ির দরজার কাছে এসে বলেন, ‘বড় উপকার করলে ভাই, বলো আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি।’
আমার জন্যে নয়, দেবদূত বলে, ‘তবে এক জনের জন্যে অবশ্যই করতে পারেন। আপনার একতলার মিস ফিনলে রক্তের সম্পর্কে আমার মাসি না হলেও তার চেয়ে অনেক বেশি। তাঁকে উঠে যেতে বলায় তিনি বড় বিপদে পড়েছেন। দয়া করে যদি...’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়’, ব্যস্ত হয়ে বলেন সুবল, ‘ও সব ব্যবসাপত্র আমার দ্বারা হবে না সে আমি আগেই বুঝেছি, নেহাত ভাগ্নের কথায়...। আমি আজই ওঁকে বলে দেব যদ্দিন এ বাড়ি আছে তত দিন ওঁকে কোত্থাও যেতে হবে না।’
পর দিন প্রথম পিরিয়ডে মিস ফিনলে বলেন, ‘কাল একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কিছুটা তোমরা কাগজে পড়েছ, কিছুটা আমি জানি...।’ কথাগুলো উনি টুম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন কেন কেউ বুঝতে পারে না।
রাতে শিরীষ গাছের দিকে তাকিয়ে টুম্পা বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, ভাল।’
‘ওর মানে তো ধন্যবাদ’, হাওয়া কথা কয়ে ওঠে, ‘আহা যদি লেখাপড়া শিখতুম তবে কী ভালই হত। ভূত হয়ে বাঁচা কি ভদ্দরলোকের কাজ। আমরা জানো তো কথা বলতে পারি, বুঝতেও। কিন্তু ‘কথামালা’ পড়ব সে বিদ্যে নেই।’
একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাল বলে, ‘ও তোমাকে বলিনি, কাল মন্দ ছিল বলে কাজটা সহজে করা গিয়েছে।
ওই যে পাথর গড়িয়ে লিকলিকেকে কুপোকাত করা ওটা মন্দর কাজ।
মন্দ পাশেই ছিল। গলার আওয়াজ করে জানান দেয় সে হাজির।
টুম্পা বলে, ‘থ্যাঙ্কস, মন্দ।’
মন্দ চমকে ওঠে বলে, ‘মানে?’
ভাল বলে দেয়, ‘ধন্যবাদ।’
টুম্পার মনে হয় স্কুল ছেড়ে কলেজে যাওয়ার আগে তাকে একটা কাজ করতে হবে। একটা ‘বর্ণপরিচয়’ লিখতে হবে, যা পড়ে যারা মানুষের ভাল করে অথচ যাদের অক্ষর পরিচয় নেই, তারা অ আ ক খ A B C D শিখে শব্দের মানে বুঝতে পারে।
‘সেটা তো একটা দারুণ কাজ হবে।’ একসঙ্গে বলে ওঠে ভাল মন্দ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.