বছর চারেক আগে গ্রামের যে জমির দাম ধার্য হয়েছিল সাড়ে চার হাজার টাকা শতক, এখন তারই দাম আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা। আর শহর এলাকায় ভিটে হলে সে জমির দর দেড় লক্ষ থেকে এক লাফে ১২ লক্ষ টাকা। জাতীয় সড়কের জন্য জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ধার্য করতে গিয়ে জমির এমনই দর প্রস্তাব করল নদিয়ার আর্বিট্রেশন কোর্ট। দর শুনে চাষিরা খুশি হলেও, জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা ক্ষু্ব্ধ।
শুক্রবার কৃষ্ণনগরের নদিয়া জেলা পরিষদের সভাকক্ষে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে শুনানি হয়। সেখানে আর্বিট্রেটর হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার রিনা ভেঙ্কটরমণ, নদিয়ার জেলাশাসক ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা। শুনানিতে ডাকা হয়েছিল জেলার ১২টি মৌজার প্রায় ১৬০০ জমিদাতাকে। জেলাশাসক পি বি সালিম জানান, ২০০৯ সালে জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণের নোটিফিকেশন করা হয়েছিল। সেই মতো ওই সালেই রাজ্য সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ আইন- ১৮৯৫ অনুসারে জমির দাম ঠিক করা হয়েছিল। জমিদাতাদের বেশির ভাগই চেক গ্রহণ করলেও, জমির দাম বাড়ানোর জন্য জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে আবেদন করেন। এ বার জাতীয় সড়ক আইন, ১৯৫৬ অনুসারে জমির দাম ধার্য করা হয়। তাতেই জমির দাম একলাফে বাড়ল কয়েক গুণ।
এ দিন শুনানি কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে কার্যত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছেন জমিদাতারা। পুঙলিয়া মৌজার বাসিন্দা অমল পাল কিংবা ভাগা মৌজার বাসিন্দা গোলাম মোস্তাফা বিশ্বাস বলেন, “এই নতুন দামে আমরা খুশি। আগে যে দাম ধার্য করা হয়েছিল তার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক ছিল না।” কিন্তু জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে আর্বিট্রেশনে উপস্থিত এক আধিকারিক বলেন, “কীসের ভিত্তিতে দাম এতটা বাড়ল? এই চার বছরের মধ্যে ওই সব মৌজায় কী এমন ঘটেছে যার জন্য জমির দাম এক লাফে এতটা বাড়িয়ে দেওয়া হল?”
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জেলার ৯২টি মৌজার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে এ বছর ২০ মে অন্য সাতটি মৌজার আর্বিট্রেশনের শুনানি হয়েছে। সেখানেও জাতীয় সড়ক আইন, ১৯৫৬ অনুসারেই দাম ধার্য হয়। তা সত্ত্বেও জমির দাম বাড়িয়ে প্রতি শতকে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা করা হয়েছিল। এ বার সেখানে এত গুণ দাম বাড়ানো হল কেন? রাজ্য সরকারের সংস্থা ‘কমপিটেন্ট অথরিটি অব ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন’-এর নির্ণয়ের ভিত্তিতেই ২০০৯ সালের দর ঠিক করা হয়েছিল। তার থেকে কেনই বা আর্বিট্রেটর-নির্দিষ্ট দামের এত ফারাক?
অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) দেবাশিস সরকার বলেন, “আমরা ২০০৮-০৯ সালে জমির দরের উপরে গড় করে দাম ধার্য করেছিলাম। তারপর এতগুলো বছর কেটে গিয়েছে। দাম তো বাড়বেই।” প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার তথা আর্বিট্রেটর রিনা ভেঙ্কটরমণ বলেন, “মূলত জমিদাতাদের দাবি আর বাজার দরকে মাথায় রেখেই জমির দাম ধার্য করা হয়েছে।”
কিন্তু জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে আইনজীবী দীপঙ্কর দাশ বলেন, “চার বছরে জমির দাম বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু সেটা কী হারে? ওই সব মৌজায় এই ক’বছরে কী এমন ঘটল যার জন্য সাড়ে চার হাজার টাকার জমির দাম বেড়ে আড়াই লক্ষ টাকা হয়ে গেল?” দীপঙ্করবাবু বলেন, “এর আগে দুর্গাপুরে আবির্র্ট্রেশনের শুনানি হয়েছে। সেখানে জমির দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ চার লক্ষ টাকা শতক।” তাঁর প্রশ্ন, দুর্গাপুরের মতো শিল্পাঞ্চলের থেকেও নদিয়ায় জমির দাম বেড়ে গেল কী করে? এ দিন শুনানি কক্ষে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের
চিফ জেনারেল ম্যানেজার এ অহলুওয়ালিয়া। নতুন নির্ধারিত
দামের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সব শুনলাম। এরপর আমাদের আইনি সেল সিদ্ধান্ত নেবে।”
তবে প্রশ্ন উঠেছে, এর আগের শুনানিতে যে জমিদাতারা শতক প্রতি সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা দাম পেয়েছেন, তাঁরা কি অন্য মৌজায় আড়াই লক্ষ টাকা দাম ধার্য হওয়ার পর ওই দাম মেনে নেবেন? দ্বিতীয়
দফার ১২টি মৌজার শুনানিতে যে ভাবে দাম উঠেছে, তাতে আগামী দিনে বাকি ৬০-৭০টি মৌজার শুনানিতে চাষিদের দাবি কোথায় পৌঁছবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আর আর্বিট্রেশনের নির্ধারিত দাম
কমাবার আর্জি নিয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ যদি আদালতে যায়, তা হলে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ যে
আরও পিছিয়ে যাবে, সে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। |