মূকদের ভাষা দেন পান্না, কুর্নিশ রাজ্যের
ন্মের পর থেকে কান্না ছাড়া কোনও শব্দ করত না মিনু। পাড়া-প্রতিবেশী থেকে আত্মীয়স্বজন, সকলে ধরে নিয়েছিল এই মেয়ের জীবন বৃথা। তার চিকিৎসায় অযথা টাকা নষ্ট হচ্ছে, এমন কথাও শুনতে হয়েছিল।
মেয়েকে কোলে নিয়ে বধিরতার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন পান্নালাল দাস। তারপর থেকে মিনুর মতো ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। গত কুড়ি বছরে তাঁর কাজের পরিধি ক্রমশ ছড়িয়েছে। তার স্বীকৃতি হিসেবেই আগামী ৩ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে’ সুতাহাটার বড়বাসুদেবপুরের এই মানুষটিকে সম্মান জানাতে চলেছে রাজ্য সরকার। সে কথা জেনে পান্নালালবাবু বলছেন, “এত দিন যে সব বাধার মুখে পড়তাম, এই পুরস্কার পাওয়ার পর হয়তো এ বার কাটবে।”
দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান পান্নালালবাবু ১৯৯২ সালে কলকাতার একটি সংস্থায় নিয়ে আসেন মিনুকে। মেয়ের সঙ্গে তিনি নিজেও মূক ও বধিরদের বাক্ প্রশিক্ষণ নেন। পরে আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে শেখেন সেই কৌশল। ক্রমে মিনুর মতো প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের সাহায্য করার তাগিদ অনুভব করেন। ১৯৯৩ সালে সুতাহাটার বাড়িতেই ‘বাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ গড়ে তোলেন পান্নালালবাবু। এখানে দুই মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া থেকে অনেক বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে আসেন। বাড়ি বাড়ি গিয়েও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পান্নালালবাবু।

আবাসিকদের সঙ্গে পান্নালালবাবু। আরিফ ইকবাল খানের তোলা ছবি।
কাজের সুবিধার জন্য কয়েকজন যুবককে দলে টেনেছেন। তাদেরও শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছেন। কাজের ক্ষেত্র আরও বাড়াতে ১৯৯৮ সালে পান্নালালবাবু তৈরি করেন ‘হলদিয়া প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্র’। ওই বছরই স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের পরিত্যক্ত ঘরে প্রায় একশো জন মূক-বধির শিশুকে নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়। ১৯৯৯ সালে ‘শ্রুতি’ নামে এই বিদ্যালয় উঠে আসে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের দেওয়া জায়গায়। পরের বছর জনশিক্ষা দফতর চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ওই বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেয়। স্কুলেই নৈশপ্রহরীর কাজ পান পান্নালালবাবু। মহিষাদলে প্রতিবন্ধীদের জন্য দু’টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন এই মানুষটি।
সমান্তরাল ভাবে চলেছে মেয়ে মিনুর লেখাপড়া। মাধ্যমিক পাশের পরে মিনু এখন হলদিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমূলক পাঠক্রমে টেলারিং প্রশিক্ষক। খেলাধুলাতেও পিছিয়ে নেই। জেলা থেকে জাতীয় স্তর, একাধিক পুরস্কার রয়েছে মিনুর ঝুলিতে। কিছুটা কথায়, কিছুটা ইশারায় মিনু বলে, “বাবা না থাকলে আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যেত।”
পান্নালালবাবু চান, প্রতিবন্ধকতা জয় করে মেয়েকে বড় করার সঙ্কল্প আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। তাঁর সামনে মস্ত বাধা ছিল অর্থাভাব। পান্নালালবাবুর কথায়, “বাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার সময় স্ত্রীর গয়না-জমি বন্ধক রেখেছি, অনেক বিক্রি করেছি। সংসারও কষ্টে চলে।” এতেও অবশ্য হাল ছাড়েননি তিনি। ‘শ্রুতি’ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পার্থ সেন জানালেন, সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর খোঁজেন পান্নালালবাবু। তাদের বাড়ির লোককে বুঝিয়ে স্কুলে ভর্তি করান। পান্নালালবাবুর স্ত্রী রিনাদেবীর কথায়, “এখনও উনি প্রতিদিন ৫০-৬০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। অনেক দিন বাড়িও ফেরেন না। ওঁর কাজে যতটা সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করি।”
পান্নালালবাবুর স্বপ্ন একটাই, প্রতিবন্ধীদের জীবন-যুদ্ধে জেতানো। তাঁর কথায়, “আমি চাই না, একজনও ‘প্রতিবন্ধী’ পরিচয় নিয়ে বাঁচুক।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.