স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য শিবিরে এসেছিলেন পূর্ণিমা মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত)। বাড়ি ঘাটাল মহকুমার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সঙ্গে গ্রামের আরও কয়েকজন মহিলা ছিলেন। শিবিরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সঙ্গে রক্ত পরীক্ষাও করা হয়। পরে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে স্বাস্থ্য-কর্তাদের উদ্বেগ বাড়ে। জানা যায়, গর্ভবতী পূর্ণিমাদেবী এইআইভি আক্রান্ত। ঘাটাল মহকুমারই আরও এক গৃহবধূর রক্তেও এইচআইভি সংক্রমণ মিলেছে।
কয়েক বছর ধরেই পশ্চিম মেদিনীপুরে এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে যেমন যুবক-যুবতীরা রয়েছেন, তেমন রয়েছে কিশোর- কিশোরীও। ২০১০ সালে এইচআইভি সংক্রমিত (সরকারি ভাবে নথিভুক্ত) রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৪০। এর মধ্যে ১৪ জনের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। ২০১৩ সালে সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ১,৩৫৪! এর মধ্যে ৯৮ জনের বয়স ১৫ বছর বা তার কম।
এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়ছে কেন? জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার মতে, “আমরা দেখেছি, যে সব এলাকার যুবকেরা কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে যান এবং কয়েক মাস পর আবার ফিরে আসেন, সেই সব এলাকাতেই এইচআইভি সংক্রমিতের সংখ্যা বেশি। এই সব ঘরছাড়াদের মধ্যেই কয়েকজন এইচআইভির বাহক হয়ে ঘরে ফিরে আসেন।” জেলার মধ্যে ঘাটাল মহকুমাতেই এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা সব থেকে বেশি। কারণ, ঘাটাল মহকুমার প্রচুর মানুষ ভিন্ রাজ্যে কাজে যান। এঁদের বেশিরভাগ যান সোনার কাজ করতে। ওই স্বাস্থ্য কর্তা জানান, একজন নানা কারণে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারেন। তার মধ্যে যৌনপল্লিতে যাতায়াত অন্যতম কারণ। |
তবে যে এডস বিরোধী জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা মানছেন, “সচেতনতা কর্মসূচি চলে। তবে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণের ঘটনা এড়াতে সবস্তরে আরও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামে।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, “এইচআইভি শনাক্তকরণের জন্য শিবির হয়। সচেতনতা কর্মসূচিও চলে। পরীক্ষার পর যাঁদের রক্তে এইচআইভি সংক্রমণ মেলে, তাঁদের কাউন্সিলিং করে গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তমালকান্তি ঘোষেরও বক্তব্য, “এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে সব রকম ব্যবস্থাই রয়েছে। এ নিয়ে সচেতনতা রয়েছে। তবে, সব স্তরে সচেতনতা আরও বাড়ানো দরকার।”
এডস প্রতিরোধে গত এক মাস ধরে জেলায় ১০টি শিবির হয়েছে। শিবিরগুলোতে গড়ে তিনশো-সাড়ে তিনশো জন এসেছেন। তার মধ্যে শতাধিক লোকের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। খড়্গপুর মহকুমার একটি শিবিরে যেমন ৩৩৫ জনের মধ্যে ১২৯ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ঘাটাল মহকুমার একটি শিবিরে ১৯৫ জনের মধ্যে ২৩ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ঘাটাল মহকুমারই অন্য একটি শিবিরে ১১৮ জনের মধ্যে ৩৬ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রক্ত পরীক্ষায় যাঁদেরএইচআইভি সংক্রমণ মেলে, তাঁদের কাউন্সেলিং করে গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
এইচআইভি আক্রান্তদের চিহ্নিত করার জন্য পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৪টি আইসিটিসি (ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সেলিং টেস্টিং সেন্টার) রয়েছে। ফেসিলেটেড আইসিটিসি রয়েছে ৪টি। তবে, এর মধ্যে দু’টি আপাতত বন্ধ। মেদিনীপুর মেডিক্যালে এআরটি সেন্টার (অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি)-ও রয়েছে। এখানে এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসা হয়। আগামী দিনে ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে একটি লিঙ্ক এআরটি সেন্টার খোলার চেষ্টা চলছে।
দুই মেদিনীপুর ছাড়াও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি, হাওড়া এমনকী ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা থেকেও এইচআইভি আক্রান্তরা মেদিনীপুর মেডিক্যালের এআরটি সেন্টারে চিকিৎসার জন্য আসেন। নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা ২,৪৮৯। এর মধ্যে ২৬৬ জনের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। এই ২৬৬ জনের মধ্যে আবার ১৪৭ জন কিশোর, ১১৯ জন কিশোরী। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “গ্রামে গ্রামে শিবির করে এইচআইভি শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। এডসের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের সকলের সামিল হওয়া জরুরি।”
|