অভিষেকের মোবাইলই ধরিয়ে দিল খুনিদের
ক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় খুন হয়ে যায় ১৯ বছরের এক তরুণ। আর পড়ন্ত এক শীতের বিকেলে মিলল বিচার। মাঝে কেটে গিয়েছে সাড়ে পাঁচ বছর।
২০০৮ সালের মে মাসে একটি ‘মিসিং ডায়েরি’ জমা পড়ে শিলিগুড়ি থানায়। এমন মিসিং ডায়েরি আকছার পান পুলিশরা। কিন্তু অভিষেক চাচান কোথায় গেল, তার তদন্তে নেমে ২৪ ঘন্টার মধ্যে যা যা সামনে এল, তাতে হাড় হিম হয়ে এল গোটা শিলিগুড়ি শহরের। এমনকী পোড়-খাওয়া পুলিশ কর্তারাও বিস্মিত। মদের সঙ্গে নেশার ওধুষ খাওয়ানো, শ্বাসরোধ করে খুন, মোবাইল লোপাট, টাকা আদায়ের চেষ্টা, মৃতদেহ বাইকে বসিয়ে পাচার করা, এমন নানা ভয়ানক ঘটনা পরপর সামনে এল।
আর এই সব ঘটানোর অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারা সদ্য গোঁফের রেখা-বেরোনো ছয় তরুণ। তাদের তিনজন আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়ুয়া। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’-র দাবিতে সেদিন গর্জে উঠেছিল শিলিগুড়ি। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়ে দিল, এক তরুণীকে ঘিরে বিবাদের জেরে খুন। শুরু হল প্রতীক্ষার লড়াই। নিহত অভিষেক চাচানের পরিবারের তো বটেই, অভিযুক্তদের পরিবারেরও দিন কাটছিল আদালতকে কেন্দ্র করে। শুক্রবার, রায় ঘোষণার দিন, তাই উৎকন্ঠার পারদ বাড়তে শুরু করেছিল সকাল থেকেই। গোটা শহর উৎকণ্ঠিত হয়েছিল, কী বিচার পায় অভিষেক।
এ দিন শিলিগুড়ি আদালত চত্বর ভিড়ে ঠাসা। সাধারণ নাগরিক, পুলিশ, আইনজীবী, কেউ বাকি নেই। এরই মধ্যে আদালত চত্বরের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন নিহত অভিষেকের বাবা অরবিন্দ চাচান। খানিক পরে এজলাসের এক কোণে বসে থাকতে দেখা গেল তাঁকে। সময় যত এগিয়েছে, ততই নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

রায় ঘোষণার পরে অভিষেক চাচান হত্যায় অভিযুক্তদের
দেখতে ভিড় জনতার। শুক্রবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অভিযুক্তরা। পাঁচ বছরে তরুণ থেকে যুবক হয়ে উঠেছে ওরা ছয়জন, সকলে একেবারে চুপচাপ। মামলার অন্যদিন ওদের নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখেছেন আদালতের কর্মীরা। এ দিন দেখা গেল উল্টো ছবি। ওদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা এজলাসের দরজায় বারবার যেন কান পেতে যেন শুনতে চাইছিলেন, বাড়ির ছেলেটা অন্যায় করেনি। আবার কয়েকজন তো আগেই ‘হাল’ ছেড়ে দিয়ে এজলাসের কয়েকশ মিটার দূরে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসেই ছিলেন। মিনিট চল্লিশের অপেক্ষা। তার পরেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল।
অভিষেকের খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলেন সুরজিৎ দাস, রোমান সরকার এবং সহিদুর রহমান। বেকসুর আনন্দ গুপ্ত, নীলকমল শর্মা এবং অমিত মণ্ডল। মুক্তি-পাওয়া নীলকমল শর্মার বাবা শত্রুঘ্ন শর্মা বলেন, “কিছুদিন ধরে ঠিক মতো কথাও বলত না ছেলে। মুক্তি যে পেয়েছে সেটাও বোধহয় আজ ও বুঝতে পারেনি।” অপর অভিযোগমুক্ত অমিত মণ্ডলের বাবা সহদেব মণ্ডল খুশি। তাঁর কথায়, “অনেক দিনের লড়াই সফল হল। ছেলেটা এবার বাঁচবে।”
আদালত সূত্রের খবর, এ দিন মামলাটি আদালতে উঠলে বিচারক জিজ্ঞাসা করেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ রয়েছে? পুলিশের পক্ষ থেকে সুরজিৎ দাস, রোমান সরকার ও সহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ দেখানো হয়। কিন্তু বাকি তিনজন আনন্দ গুপ্ত, নীলকমল শর্মা এবং অমিত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ বা যুক্তি দেখানো যায়নি। সরকারি আইনজীবী পীযূষ ঘোষকে বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, আর কিছু পেশ করা বাকি আছে কিনা। পীযূষবাবু, ‘নেই’ জানিয়ে দেওয়ায় মামলার ভাগ্য তখনই নির্ধারিত হয়ে যায়। এর পরে ১০ মিনিট সময় নিয়ে বিচারক আনন্দ, নীলকমল ও অমিতকে বেকসুর খালাসের কথা ঘোষণা করে দেন। বিচারক আদালতে জানিয়ে দেন, সুরজিত মূল দোষী, রোমান ও সহিদুরকে খুনের কাজে সাহায্য ও তথ্য প্রমাণ লোপাটে সাহায্য করার অপরাধে অপরাধী ঘোষণা করা হচ্ছে। শনিবার সকালে সাজা ঘোষণা করা হবে।
অভিষেক খুন হওয়ার ৯০ দিনের আগেই আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের দাবি, মামলার সহজ সমাধানের কাজটা করে দিয়েছিল অভিযুক্তরাই, নিহতের মোবাইল ব্যবহার করে। রাতারাতি সিম বদলে ফেললেও অভিষেকের মোবাইলের ‘আইএমইআই’ নম্বর, কল রেকর্ড ঘেঁটে মামলার গোড়ায় পৌঁছনো হয়। তদন্তকারী অফিসার রাম সিংহ ছাড়াও তৎকালীন শিলিগুড়ি থানার অপরাধ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার দীপাঞ্জন দাস ২০০৮ মে-জুন মাসের ক’টা রাত ঘুমিয়েছিলেন, তা এখনও মনে করতে পারেন না।
তদন্তের সময় সারণী
২০০৮, ২২ মে বাড়ি থেকে কম্পিউটারের কিবোর্ড ঠিক করে বেরিয়ে কলসেন্টার কর্মী অভিষেক চাচান নিখোঁজ হয়।
২০০৮, ২৪ মে ফাঁসিদেওয়ার লিউসিপাখুরির থেকে দেহ উদ্ধার।
২০০৮, ২৭ মে অভিষেকের মোবাইলের রেকর্ড ঘেঁটে ধৃত মূল অভিযুক্ত সুরজিৎ দাস-সব ছ’জন।
২০০৮, ৩১ মে অভিযুক্তদের নিয়ে পুলিশ শিলিগুড়ি-ফাঁসিদেওয়া অবধি ঘটনাক্রমের তদন্ত করে।
২০০৮, ২২ অগস্ট অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল।
২০০৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি চাচান মামলার শুনানি শুরু। মোট ৪১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
২০১৩, ২৯ নভেম্বর দোষী সাব্যস্ত তিন। বাকি তিন বেকসুর খালাস।
২০১৩, ৩০ নভেম্বর আজ, দোষীদের সাজা ঘোষণা।
ঠিক কী ঘটেছিল অভিষেকের খুনের দিন, সন্ধ্যা থেকে রাতে?
পুলিশ জানিয়েছিল, মেরামত করতে দেওয়া কম্পিউটার কী বোর্ড এবং মাউস আনতে বাড়ি থেকে বার হয়ে সেবক রোডে যান কল সেন্টারের কর্মী অভিষেক চাচান। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত পরিবারের লোকেদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকলেও তার পরে আর অভিষেকের খোঁজ মেলেনি। ওই রাতে শিলিগুড়ি হাসপাতালের পার্কিং এরিয়া থেকে অভিষেকের বাইক পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়। ২৪ মে সকালে ফাঁসিদেওয়ার মধুজোতে একটি কালভার্টের তলা থেকে অভিষেকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ ছয়জনে ধরে।
আদালতে পুলিশ জানায়, সুরজিতের এক বান্ধবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিরোধের জেরেই ২২ তারিখ ওই ছয় অভিযুক্ত মিলে অভিষেককে সুভাষপল্লিরর একটি বাড়িতে ডেকে, বিয়ারের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করে দেয়। তার পরে শ্বাসরোধ করে খুন করে। রাতভর দেহ পাহারা দেয় অভিযুক্তরা। পরদিন রাতে রোমান এবং সহিদুর মিলে মোটর সাইকেলে অভিষেকের মৃতদেহ তুলে নিয়ে ফাঁসিদেওয়ায় ফেলে আসে। অভিষেকের মোবাইল সুরজিতের কাছ থেকে উদ্ধার হয়। সেই সঙ্গে কম্পিউটারের কি বোর্ড, মাউস, নাইলনের দড়ি উদ্ধার করা হয়েছে বলে আদালতে জানায় পুলিশ। বাইকের মাঝে দেহ নিয়ে কীভাবে অভিযুক্ত দুইজন ফাঁসিদেওয়া গেল, ঘটনাস্থলে অভিযুক্তদের নিয়ে গিয়ে তার ‘নাট্যরূপ’ রচনা করিয়ে হতবাক হয়ে যান পুলিশ অফিসারেরা। প্রায় সাত-আট কিলোমিটার একটি মৃতদেহ কী ভাবে দু’জন আরোহীর মাঝখানে মোটর সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে গেল ওরা, তা ভেবে তাঁরাও বিস্মিত হন।
দীপাঞ্জনবাবু এখন ভক্তিনগর থানার ট্রাফিক ওসি। শুক্রবার রায়ের খবর পেয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হল।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.