সারদা-কাণ্ডে বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণের জবাবে এ বার পাল্টা মুখ খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ গ্রেফতারের পর থেকেই সিপিএম-সহ বিরোধীরা সারদা-কাণ্ড নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে। লোকসভা ভোটের প্রচারেও বিরোধীরা যে সারদা-কাণ্ডকে হাতিয়ার করবে, তা-ও স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে পাল্টা আক্রমণের পথেই হাঁটলেন তৃণমূল নেত্রী। শুক্রবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলের কার্যকরী কমিটির বর্ধিত সভায় তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য, “আমার দল চিট ফান্ডের টাকায় চলে না।” একই সঙ্গে এ ব্যাপারে বিরোধীদের প্রচার কী ভাবে ভোঁতা করতে হবে, দলের কর্মীদের সে পথও দেখিয়েছেন মমতা। তাঁর নির্দেশ, “সিপিএম মানে সর্বনাশ এটা সব জায়গায় লিখবেন।’’
এ দিন দলীয় কর্মীদের সভায় এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতার শেষ ভাগে বেআইনি লগ্নি সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে মুখ খুলে সিপিএমকে রীতিমতো তুলোধনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ কুণালের গ্রেফতারের পর থেকে সিবিআই তদন্তের দাবিতে বিধানসভার অধিবেশনে এবং রাজপথে বামেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সরব। গত কালই বিধাননগরে থানায় এ নিয়ে বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। গত কাল বরাহনগরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন যে, রাজ্যে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেআইনি লগ্নি সংস্থার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। এ দিনও রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে বামেদের প্রতিবাদ-অবস্থানে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম এক যোগে মমতাকে এ নিয়ে কটাক্ষ করেন। তাঁদের প্রশ্ন, “মমতা যদি সততার প্রতীক হন, তা হলে তিনি কেন সিবিআই তদন্ত এড়িয়ে যাচ্ছেন?”
সিপিএমের সুরেই কংগ্রেসও সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে। দুই বিরোধী দলের এই যৌথ আক্রমণ সামাল দিতে এ দিন দু’দলকেই একযোগে নিশানা করেন মমতা। তবে তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল সাড়ে তিন দশকের শাসক সিপিএম। সভায় তিনি এ দিন বলেন “সিপিএম সবচেয়ে বড় প্রতারক। ৩৫ বছর ধরে তারা রাজ্যে চিট ফান্ডের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। সিপিএমের এত টাকা যে, তারা সেই টাকা চিট ফান্ডে লাগাত!” |
দলীয় বৈঠকে যোগ দিতে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে যাচ্ছেন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: সুমন বল্লভ। |
এর পরেই কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারকে উদ্দেশ করে তাঁর তোপ, “কেন্দ্রীয় সরকার, সেবি কী করছিল? কেন্দ্র তো কোনও আইন পাশ করছে না। আমরা তো কমিশন করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করেছি।” তাঁর সরকারের পুলিশই যে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে কাশ্মীর থেকে গ্রেফতার করেছে, সে কথা উল্লেখ করে বিরোধীদের প্রতি তাঁর বক্রোক্তি, ‘‘যারা বড় বড় চোর, তারাই ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছে!”
সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানো প্রসঙ্গে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণের চেক ফেরৎ আসছে। কারণ, আবেদনকারীদের কোনও অস্তিত্বই নেই! সরকার বেনামে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে যাতে টাকা দিতে না হয়।” যদিও ক্ষুদিরামের সভায় মমতা জানিয়েছেন, তাঁর সরকার ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীর হাতে ইতিমধ্যেই দশ হাজার করে টাকা তুলে দিয়েছে।
দলের নেতা-কর্মীদের আরও ভদ্র ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার উপরে এ দিন ফের জোর দেন মমতা। জোর করে টাকা আদায় করা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে, সে প্রসঙ্গে তিনি এ দিন বলেন, “আমাদের টাকা তুলে দল চালানোর দরকার নেই। তৃণমূল এই মানসিকতায় বিশ্বাস করে না।” সেই সঙ্গে দলকে তাঁর হুঁশিয়ারি, যে দিন এমন হবে, সে দিন তিনি আর দলে থাকবেন না।
বস্তুত লোকসভা ভোটের আগে দলকে সাংগঠনিক ভাবে আরও মজবুত করা এবং আগামী ৩০ জানুয়ারি দলের ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্যেই এ দিন ক্ষুদিরামে সভা ডাকা হয়। দলের জেলা পরিষদের নয়া সভাধিপতি, সদস্য এবং পুরভোটে দলের জয়ী চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরদের উপস্থিতিতে উন্নয়নের কাজ তরান্বিত করার জন্য সভায় আবেদন করেন মমতা। জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সদস্যদের মমতার স্পষ্ট নির্দেশ, কোনও প্রকল্পের কাজ ফেলে রাখা যাবে না। অসমাপ্ত কাজ নিয়ে বিরোধীরা যাতে কোনও সমালোচনার সুযোগ না পান, সে দিকে লক্ষ রেখে দলীয় জনপ্রতিনিধিদের কাজ করার পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কোনও প্রকল্প ঘোষণা করে দিয়ে চলে এলাম, তা হবে না। আমাদের কতটুকু এক্তিয়ারে পড়ে, অর্থের সংস্থান আছে কি না, সেটা দেখে কাজ করতে হবে।” না হলে যে শুধু সরকার নয়, দলেরও ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, “আমি এমন কাজ বা ঘোষণা করি না, যা আমি করতে পারব না।”
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবি এবং বৃহস্পতিবার বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের সামনের ঘটনা নিয়ে এ দিন বামফ্রন্টের বৈঠকে আলোচনা হয়। এ দিন বিধানসভার অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিধাননগরের ঘটনা নিয়ে বাম বিধায়করা বিক্ষোভ দেখান এবং ওয়াক আউট করেন। সারদা-কাণ্ড যে সিপিএম সহজে হাতছাড়া করবে না, তা আজ ফের স্পষ্ট করে দিয়েছে দল। বিষয়টি নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতার পাশাপাশি জেলাতেও আন্দোলনে নামবে সিপিএম। এ দিন বিরোধী দলনেতা বলেন, “আন্দোলনের ভাষা ছাড়া তৃণমূলের সরকার অন্য কোনও ভাষা বোঝে না।”
আড়াই বছর আগে বিরোধী আসনে থাকা তৃণমূলের নেতারাও এ কথাই বলতেন। সে সময় শাসক বামেরা বিরোধীদের মোকাবিলায় পাল্টা রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলতেন। এ দিন মমতা কিন্তু বিরোধীদের মোকাবিলায় নতুন পথ দেখালেন। উন্নয়ন। রাজনৈতিক নেত্রী থেকে প্রশাসক হয়ে ওঠার পথে উন্নয়নই যে তাঁর হাতিয়ার, তা স্পষ্ট করে দিয়ে মমতা এ দিন বলেন, “আমাদের লড়াই একটাই।
তা হল বাংলাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।” |