রোজই ভোর ৪টে নাগাদ উঠে পড়তেন স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে তাঁদের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ দেখে সন্দেহ হয় প্রতিবেশীদের। বহু বার কলিং বেল বাজিয়ে এবং ফোন করেও দম্পতির সাড়া না মেলায়, বাড়ি সারাই করতে আসা এক মিস্ত্রিকে ডাকেন তাঁরা। তিনি কার্নিশে উঠে জানলার কাচ ভেঙে ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে জানান, খাটে দু’জনেই শুয়ে রয়েছেন। ঘরে পাখা চলছে।
তিলজলা থানা এলাকার এক আবাসনের তিন তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে শুক্রবার সকালে এ ভাবেই উদ্ধার হল এক মধ্যবয়স্ক দম্পতির মৃতদেহ। মৃতদের নাম সিদ্ধার্থ পাধি (৫০) এবং শীলা পাধি (৪৫)। তাঁদের আদি বাড়ি ওড়িশায়। এ দিন ঘটনার খবর পেয়ে তিলজলা থানার পুলিশ যায়। আসেন লালবাজারের গোয়েন্দারাও। দরজা ভেঙে দেহ দু’টি উদ্ধার করে এনআরএস হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ঘর থেকে সিদ্ধার্থবাবুর সই করা, ওড়িয়া ভাষায় লেখা একটি সুইসাইড নোট পেয়েছে পুলিশ। সেখানে অবশ্য এই ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করে যাওয়া হয়নি। |
কী হয়েছিল এ দিন? প্রতিবেশীরা জানান, পাধি দম্পতির কোনও সন্তান ছিল না। অনুপম নামে পাশের ফ্ল্যাটের বছর ছয়েকের একটি ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন তাঁরা। রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে ‘আন্টি’-কে গুড মর্নিং বলে যেত অনুপম। তবে, এ দিন সকালে একাধিক বার কলিং বেল বাজালেও আন্টির কোনও সাড়া পায়নি সে। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে মা-কে পুরো বিষয়টি জানিয়ে স্কুলে চলে যায় অনুপম।
অন্য দিকে, রোজ সকালে আবাসনের সামনের আড্ডায় সবার আগে পৌঁছনোর ‘রেকর্ড’ ছিল সিদ্ধার্থবাবুর, যার ব্যতিক্রম কখনও হত না। তাই এ দিন সকাল সাড়ে ৭টা বেজে গেলেও তাঁর সাড়া না পেয়ে অবাকই হয়েছিলেন প্রতিবেশীরা। ওই আবাসনের সোসাইটির সচিব সূর্যনারায়ণ বসুরায়চৌধুরী জানান, অনুপমের মায়ের কাছে তাঁরা সকালের ঘটনাটি জানতে পারেন। এর পরে সবাই মিলে আবাসনে কর্মরত এক মিস্ত্রিকে ডাকেন। তিনি কার্নিশে উঠে বন্ধ জানলার কাচ ভেঙে লাঠি দিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখেন, সিদ্ধার্থবাবু ও শীলাদেবী খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। ঘরে পাখা চলছে। আরও ডেকেও সাড়া না মেলায় পুলিশে খবর দেন বাসিন্দারা।
আবাসনের চারতলার এক বাসিন্দা জয়ন্ত সাহা বলেন,“ঘরে ঢুকে দেখি খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছেন সিদ্ধার্থ। তাঁর পাশে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন শীলা। সিদ্ধার্থের মুখ দিয়ে ফ্যানা বেরিয়েছিল। ঘর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছিল।” জয়ন্তবাবুর স্ত্রী শান্তশ্রী বলেন, “বৃহস্পতিবার বিকেলেই দাদা-বৌদিকে দেখেছিলাম। ওষুধের দোকান থেকে ফিরছিলেন। আমি তাঁদের জন্য অপেক্ষাও করলাম কিছুক্ষণ। দেখে মনে হল আমায় একটু এড়িয়ে গেলেন। তখনও ভাবতে পারিনি তাঁরা এরকম কিছু করার পরিকল্পনা করেছিলেন।” প্রতিবেশীরা জানান, প্রথম দিকে সিদ্ধার্থবাবুর চামড়ার ব্যবসা থাকলেও বর্তমানে তিনি প্লাস্টিক শিট তৈরির ব্যবসা করছিলেন। মাঝে মধ্যেই তাঁকে ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হত। কম কথা বললেও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন ওই দম্পতি। তবে, সম্প্রতি ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিল বলে সিদ্ধার্থবাবু প্রতিবেশীদের জানিয়েছিলেন। পুলিশ জানায়, প্রাথমিক তদন্তে ঘরের মধ্যে একটি বাটিতে সবুজ রঙের তরল মিলেছে। মিলেছে ওই তরলের অবশিষ্ট-সহ দু’টি গ্লাসও। উদ্ধার হয়েছে কীটনাশকের একটি খালি বোতল। সেগুলি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, ওই তরল খেয়েই পাধি দম্পতি আত্মঘাতী হয়েছেন। তবে, কী কারণে এমন ঘটনা ঘটল পুলিশ তা তদন্ত করে দেখছে। রৌরকেল্লায় ওই দম্পতির আত্মীয়দের খবর পাঠানো হয়েছে। |