খর্বুটে সুপুরি গাছটা পাতা-টাতা খসিয়ে খয়াটে হয়ে গিয়েছে। ভাঙা বাঁশের বেড়া, চিড় খাওয়া মাটির দেওয়াল, বিধ্বস্ত খোড়ো চাল। চার বছর আগের আয়লার সেই দুপুরটা এখনও জেগে রয়েছে বাড়িটায়।
গুটি কয়েক স্বল্প-পালক রোগাটে মুরগি সেই ভাঙা ভিটের উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ায়।
--“নে আর দাঁইড়ে থাকিসনি। উত্তুরে হাওয়া ছেড়েছে। জ্বর-জ্বালা হলি কিন্তু, সারবেনি, আমার মতো!”
লক্ষ্মী মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) বিড় বিড় করেন।
নিত্য জ্বর, খুসখুসে কাশি। রাতের দিকে হাঁফ ধরা। সারতে চায় না। শঙ্খচূড় নদীর কোলে তাঁদের রামগঙ্গা গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের পথ্য হার মানায় নদী পেরিয়ে সুলতানপুরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েই বুঝেছিলেন রোগটা নাছোড়। লক্ষ্মীর বুক কেঁপেছিল, ‘স্বামীর রোগে ধরল না তো!’
রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ সংস্থার হয়ে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনর্গল সমীক্ষা চালায় পিএলডব্লিউএইচএ (পিপল লিভিং উইথ এইচআইভি অ্যান্ড এড্স)। সন্দেহটা দানা বাঁধতে তাঁদের কাছেই সটান হাজির হয়েছিলেন লক্ষ্মী। ওই সংস্থার কর্মীরাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার বাঙ্গুর হাসপাতালে। রক্ত পরীক্ষার পরেই ধরা পড়েছিল, লক্ষ্মীর শঙ্কাটা মিথ্যে নয়, এড্স।
সুন্দরবনের প্রান্তিক সেই গ্রামে, আয়লার পরোক্ষ শিকার লক্ষ্মী এখন দুই নাবালক সন্তান নিয়ে একা এবং মৃত্যুমুখী। কিন্তু সত্যিই কি একা?
সরকারি পরিসংখ্যান কিন্তু সে কথা বলছে না। সুন্দরবনের অজস্র নদী-নালা-খাঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গ্রাম ঘুরে স্বাস্থ্য দফতরের এড্স নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ সংস্থার হয়ে এইচআইভি সংক্রমণের হদিস করে বেড়ায় পিএলডব্লিউএইচএ। তাদের তথ্য বলছে, আয়লা পরবর্তী সুন্দরবনে এড্স এখন শিরে সংক্রান্তি। |
সম্প্রতি স্বাস্থ্যভবনে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে পিএলডব্লিউএইচএ। তাতে বলা হয়েছে, ২০০৯’র ২৫ মে আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনের ১১টি ব্লকে এড্স কিংবা এইচআইভি সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। কেন?
আয়লার দুর্যোগে সুন্দরবনের দ্বীপগুলির অধিকাংশই তলিয়ে গিয়েছিল জলের তলায়। ঘর-বাড়ি, পোষ্য-স্বজনই নয়, জলোচ্ছ্বাসে হারিয়ে গিয়েছিল ধানি জমিও। সুন্দরবনের অন্তত ১৪৮টি দ্বীপের মধ্যে সাকুল্যে ৪৭টিতে বসত রয়েছে। রুজির খোঁজে, পাথরপ্রতিমা থেকে গোসাবা, বিভিন্ন ব্লকের কয়েক হাজার মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল। সংসার ফেলে তাঁদের অনেকেই গিয়েছিলেন আমদাবাদ, সুরাত কিংবা মুম্বইয়ে। বছর খানেক পর থেকে তাঁদের স্ব-দ্বীপে প্রত্যাবর্তন শুরু হলেও অধিকাংশেরই তখন ভগ্ন স্বাস্থ্য। বিভিন্ন ধরনের পেটের অসুখ, চর্মরোগ, হেপাটাইটিস-বি তো ছিলই, আর ছিল, এইচআইভি’র সংক্রমণ।
লক্ষ্মী মণ্ডলের স্বামী নিতাই ছিলেন সেই তালিকায়। জরির কাজ করতে তিনি গিয়েছিলেন সুরাত। বছর খানেক পরে ফিরে এসেছিলেন। তবে স্বাচ্ছন্দ্য নয়, সঙ্গে করে বয়ে এনেছিলেন এড্স। বছর ঘুরতেই মারা গিয়েছিলেন নিতাই। তাঁর রোগের উত্তরসূরি করে গিয়েছিলেন স্ত্রী লক্ষ্মীকে।
বাসন্তী, ক্যানিং, গোসাবা, কাকদ্বীপের মতো ১১টি আয়লা বিধ্বস্ত ব্লকে ছড়িয়ে রয়েছেন এমনই অজস্র ‘নিতাই মণ্ডল’। গত দু’বছর ধরে তাঁদের উপরেই সমীক্ষা চালিয়ে পিএলডব্লিউএইচএ’র রিপোর্ট বলছে, আয়লার পরে মূলত জরি-শিল্প, স্বর্ণশিল্প কিংবা রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে দ্বীপ ছেড়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রবাসে থাকাকালীনই যে তাঁদের এইচআইভি সংক্রমণও ঘটেছে, রক্ত পরীক্ষায় তারই প্রমাণ মিলেছে। পিএলডব্লিউএইচএ’র সভাপতি ক্ষিতীশ মণ্ডল বলেন, “আয়লা বিধ্বস্ত প্রতিটি ব্লকেই এড্স আক্রান্তের সংখ্যা ভয়ঙ্কর বেড়ে গিয়েছে। তার স্পষ্ট নমুনা ক্যানিং-১ ব্লক। আয়লার আগে সেখানে এড্স আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৫, এখন ৪৭।”
ওই সংস্থার পক্ষে অজয় নস্কর বলেন, “মনে রাখতে হবে, যে তথ্য আমরা পেয়েছি তার বাইরেও বহু আক্রান্ত রয়েছেন। সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে অনেকেই রোগটাই আড়াল করছেন।” বিষয়টি নজরে এসেছে স্বাস্থ্য দফতরের এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার। ওই সংস্থার অধিকর্তা উৎপল চট্ট্যোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামে গঞ্জে ঘুরে এড্স আক্রান্তকে চিহ্নিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।”
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘নাইসেড’-এর রিপোর্টেও ধ্বস্ত সুন্দরবনের কথা উঠে এসেছে। আয়লা পরবর্তী সুন্দরবন যে কার্যত রোগের আঁতুর ঘর তা স্বীকার করেছেন নাইসেডের গবেষক সমীরণ পন্ডা। ন্যাশনাল এড্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটও প্রায় দেড় বছর ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকে স্বাস্থ্য ও অপুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়ে যে রিপোর্ট পেশ করেছে তাতেও প্রায় একই ছবি। ইনস্টিটিউটের গবেষক পি স্বামীনাথন বলেন, “আয়লার সময়ে পরিবার গ্রামে রেখেই সুন্দরবন ছেড়ে ছিলেন বহু মানুষ। বাইরে থাকার সময়ে যৌনপল্লিতে যাতায়াতই তাঁদের এড্স সংক্রমণের কারণ।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসীম দাস মালাকারও বলেন, “সে জন্যই কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে যাওয়া মানুষজন দ্বীপে ফিরলেই শিবির করে রক্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাতে অন্য রোগের সঙ্গে অনেকেরই এড্সের জীবাণুও মিলেছে।”
একই অভিজ্ঞতা তুষার কাঞ্জিলালের। পরিচিত এই সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ জানান, রাঙাবেলিয়ায় তাঁদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাসপাতালে নানাবিধ রোগ-সংক্রমণ নিয়ে আসা মানুষের ভিড়। তাঁর পরামর্শ, “সুন্দরবনের সার্বিক স্বাস্থ্য ফেরাতে আয়লা ধ্বস্ত গ্রাম ছেড়ে যাওয়া মানুষজনের ঘরে ফেরা মাত্রই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। না হলে গভীর দুর্দিন।” শঙ্খচূড় নদীর কোলে লক্ষ্মী মণ্ডলের বিধ্বস্ত বাড়িটা সে কথাই বলছে। |