সুন্দরবনের গোসাবা থেকে নদী পেরিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন হরিপদ বর্মন। মন্ত্রীর ঘোষণা শেষ হতেই খুশিতে উঠে দাঁড়ালেন গ্রামবাংলার যাত্রাপাগল ওই উদ্যোক্তা। বর্ধমানের কানরার শুভঙ্কর ঘোষ বা পূর্ব মেদিনীপুরের বলাইপণ্ডার বিবেক মাইতিরও মুখে হাসি ধরছে না। যাত্রাদলের যাত্রাপথ যে এতটা সুগম হয়ে উঠতে পারে, এত দিন স্বপ্নেও ভাবেননি পাড়াগাঁয়ে যাত্রাপালার ওই আয়োজকেরা।
যাত্রার পথে কীসের এত ঝঞ্ঝাট? তা হটানোই বা হল কী ভাবে?
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাগবাজারে ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে সেটাই বলছিলেন হরিপদবাবু। তাঁর কথায়, “গোসাবার আমতলিতে যাত্রার আয়োজন করা যে কী ঝকমারির ব্যাপার! একটু যাত্রা শুনতে কষ্টের শেষ নেই আমাদের। পুলিশের অনুমতি নিতে গেলে তারা কখন কী চাইবে, ঠিক নেই। এ-সব ঝামেলা দূর হলে কী যে শান্তি পাব!”
যাত্রা সংগঠকদের এ-সব সমস্যা দূর করতে এ বার গোটা রাজ্যেই যাত্রার আসরের জন্য বিনোদন কর, পুলিশ ও দমকল পরিষেবার খরচ বেঁধে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই সঙ্গে লটবহরসুদ্ধ বাসে-গাড়িতে যাত্রা করতে বেরিয়ে কলাকুশলী-শিল্পীদের পথের কাঁটা দূর করার দাওয়াইও মিলেছে। আগে কোনও না-কোনও কারণ দেখিয়ে গাড়ির পথ আটকে পুলিশ বা স্থানীয় লোকজন টাকা চাইত বলে অভিযোগ। এখন যাবতীয় নথি দেখিয়ে যাত্রাদলের বাস ও গাড়ির জন্য ছাড়পত্র তথা পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমির স্টিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
যাত্রার এখন ভরা মরসুম। বাগবাজারে যাত্রা অ্যাকাডেমির সভাপতি তথা যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস উদ্যোক্তাদের মুশকিল আসানের ঘোষণা করামাত্র যাত্রাকর্মী, প্রযোজক, সংগঠকদের তুমুল হাততালি পড়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে। অরূপবাবু বলেন, “যাত্রার জন্য দরদের কথা শুধু মুখে বলে কী লাভ! যাত্রাকে বাঁচাতে আমরা হাতে-কলমে কাজ করছি। যাত্রার এগিয়ে চলা ঠেকায় কে!” |
যাত্রা আয়োজনের নামে পুলিশি জুলুমের অভিযোগ কার্যত মেনে নিয়েছে রাজ্য সরকার। সমস্যার মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যাত্রা সংক্রান্ত একটি আদেশনামা প্রকাশ করেছে তথ্য-সংস্কৃতি দফতর। তাতে বলা হয়েছে, যাত্রা করতে যাওয়ার পথে বাস, ছোট গাড়িগুলিকে প্রায়ই অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। এই অসুবিধা দূর করতেই গাড়ির ব্লু বুক ও অন্য নথি দেখে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের যুগ্মসচিবের সই সংবলিত স্টিকার দেবে রাজ্য সরকার।
অভিনেত্রী তাপসী রায়চৌধুরীর কথায়, গাড়িতে বা বাসে মালপত্র, সাউন্ডের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার ছাড়পত্র দিলে বিরাট সুবিধা হবে। যাত্রাদল অযথা ভোগান্তি থেকে বাঁচবে। আগে পথেই অহেতুক কয়েক হাজার টাকা বেরিয়ে যেত।”
যাত্রার উদ্যোক্তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিনোদন কর (২০০ টাকা), পুলিশ কর (১২৫০ টাকা) ও অগ্নি পরিষেবা কর (৫০০ টাকা) বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে দমকলের ক্ষেত্রে শুধু ছাড়পত্র দিতে ৫০০ টাকা লাগবে। যাত্রাস্থলে অগ্নি সুরক্ষায় কিছু ব্যবস্থা নিতে হলে জমা দিতে হবে ২৫০০ টাকা। আর পালায় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় শিল্পীরা থাকলে ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশি আয়োজনের খরচ বেড়ে হবে ৫০০০ টাকা। যাত্রা অ্যাকাডেমির অন্যতম কর্তা তথা প্রবীণ যাত্রা প্রযোজক কনক ভট্টাচার্য বললেন, “দরকারে এই নির্দিষ্ট টাকাটুকু দিতে মনে হয় না কোনও উদ্যোক্তার আপত্তি থাকবে। কিন্তু ভাবতে পারেন, আগে এই খরচাটা বেড়ে ইচ্ছেমতো ৩০ হাজার কি ৫০ হাজার টাকা হয়ে যেত!”
উদ্যোক্তাদের উপরে এই বাড়তি খরচের বোঝার জন্যই যাত্রাদলের প্রাপ্য টাকাতেও টান পড়ার কথা শোনালেন কনকবাবু। তাঁর দাবি, “গত দু’-এক বছরে বর্ধমানে ও উত্তরবঙ্গের পুলিশের খরচ মেটাতে গিয়ে শো বাতিল করার ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক বছর ধরে যাত্রার ছাড়পত্রের জন্য জুলুম রীতিমতো বেড়ে গিয়েছিল।”
তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের তরফে বলা হয়েছে, এই ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ জেলা স্তরের প্রশাসনিক কর্তাদের ঠিকঠাক মেনে চলতে হবে। যাত্রা অ্যাকাডেমির কর্তা অরূপবাবু আশাবাদী, “এ-সব সমস্যা দূর হলে গ্রামবাংলায় যাত্রা ফের সিনেমার মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।”
|
স্বাগত প্রিয়ঙ্কা: বৃহস্পতিবার জোধপুর বিমানবন্দরে। ছবি: পিটিআই। |
|