পুকুর পাড়ে শৌচকর্ম। সেই পুকুরেই গরু মহিষের সঙ্গে মানুষের স্নান, বাসন ধোয়া থেকে ঠিক সময়ে নলকূপ পরিশুদ্ধ না হওয়া—এ সবের জেরে আন্ত্রিকের ছোবল থেকে রক্ষা পেল না বাঁকুড়া জেলা।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে আন্ত্রিকে আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত গোটা রাজ্যে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে সারা বছরে এই সংখ্যাটা ছিল ১৫৬। রাজ্য জুড়ে চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ১০ লক্ষের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
বাঁকুড়ায় আন্ত্রিকের প্রকোপ দেখা দেয় আগস্ট মাস থেকে। এখনও পর্যন্ত পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। তুলনায় কমেছে ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা। স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, ২০১২ সালে বাঁকুড়ায় বিভিন্ন এলাকায় ১১ বার আন্ত্রিক ছড়িয়েছিল। চলতি বছরে গত তিন মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩টিতে। ঘুরে ফিরে ওন্দা ব্লকেই প্রায় আটবার আন্ত্রিকের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এই বছর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ওন্দা ব্লক থেকেই চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
আন্ত্রিক এ বার বাড়ল কেন? বেশ কিছু কারণ ব্যাখ্যা করছেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকেরা। যার মধ্যে অন্যতম এই রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব। এ ছাড়াও সঠিক সময়ে নলকূপ পরিস্কারের কাজ না হওয়া ও অতিবৃষ্টি আন্ত্রিক ছড়ানোর অন্যতম কারণ। স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের কথায়, “আন্ত্রিক কবলিত এলাকাগুলিতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, পুকুরের জল থেকেই সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে এই রোগ। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবারেই শৌচাগার নেই। ওন্দা ব্লকেই শৌচাগার না থাকা পরিবারের সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিকের কথায়, “বহু পরিবার এমন রয়েছে যাদের নিজস্ব শৌচাগার নেই। এলাকার পুকুর পাড়ে খোলা আকাশের নীচে তাঁরা শৌচকর্ম সারেন। পুকুর পাড়ের সেই নোংরা বৃষ্টির জলে পুকুরে নেমে আসে। সেই জল ব্যবহার করায় আন্ত্রিক ছড়াচ্ছে।”
পুকুরের জল দূষিত হওয়ার অন্য কারণও রয়েছে। গরু, বাছুর, মোষ পুকুরে স্নান করানো জল দূষণের অন্যতম কারণ। ওই জলেই অনেক মানুষ স্নান করেন, মুখ ধোয়া থেকে থালা-বাসন ধোওয়ার কাজ করেন। দূষিত জল ঢুকে পেটের গোলমাল হচ্ছে। এক ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কথায়, “এক বিন্দু দূষিত জল পেটে গেলেও আন্ত্রিক হতে পারে। শুধু পুকুরের জলই নয়। নলকূপের জল থেকেও কিছু জায়গায় আন্ত্রিক ছড়িয়েছে।” স্বাস্থ্যকর্তাদের অভিজ্ঞতা, কিছু জায়গায় নলকূপের পাশেই নালা থাকে। সেই নালার জমা জল মাটির নীচে ঢুকে নলকূপের জলকেও দূষিত করে।
এ বারে আন্ত্রিকের জন্য বৃষ্টির বাড়বাড়ন্ত যেমন রয়েছে, তেমনি পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে যাওয়াও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা। তাঁদের মতে, মে-জুন মাসে বর্ষা আসার আগে স্বাস্থ্য দফতর পঞ্চায়েতগুলির সহযোগিতায় গ্রামাঞ্চলের নলকূপগুলির জল পরিশুদ্ধ করার কাজ করে। তারপর বর্ষা চলাকালীন ও বর্ষার শেষে একবার করে নলকূপ পরিশুদ্ধ করার কথা। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে যাওয়ায় এ বার সেই কাজ ঠিকমতো করা যায়নি। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, আন্ত্রিক হলে পাতলা পায়খানার সঙ্গে শরীরের সোডিয়াম, পটাশিয়াম বের হয়ে যায়। এতে কিডনি বা হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রথম অবস্থায় রোগীকে ‘ওআরএস’ অথবা নুন ও চিনির শরবৎ খাওয়ানো হলে আন্ত্রিকে মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে এখনও অনেকের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মৌমিতা বসু বলেন, “বাড়ির বাইরে শৌচকর্ম করা যে কতটা ক্ষতিকর তা মানুষকে জানানো দরকার।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে দাবি, গত বছর বাঁকুড়ায় ডেঙ্গির প্রকোপে দু’জনের এবং ম্যালেরিয়ায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সচেতনতার জন্য এ বার ডেঙ্গিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ম্যালেরিয়াতেও মৃত্যু কমে দাঁড়িয়েছে তিন। জেলার ডেপুটি সিএমওএইচ ২ দেবাশিস রায় বলেন, “মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে মানুষ এখন সতর্ক হলেও পেটের রোগ নিয়ে তা তৈরি হয়নি।” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, “আন্ত্রিক নিয়ে সচেতনায় জোর দিচ্ছি আমরা। আশাকর্মীদেরও এই কাজে যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।” সেই সঙ্গে পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর আশ্বাস, “আন্ত্রিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করব আমরা।” |