যথাযথ পরিকাঠামো না-থাকায় মামুলি নাগরিক পরিষেবাই তারা ঠিকমতো জুগিয়ে উঠতে পারছে না। রাজ্যের গণ-পরিবহণের হাল ফেরাতে সেই পুরসভাগুলোকে এ বার বাস চালানোর দায়িত্ব দিতে ইচ্ছুক পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র! তাঁর প্রস্তাবের বাস্তব ভিত্তি নিয়ে অবশ্য সরকারি মহলেই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, এমনকী স্বয়ং পুরমন্ত্রীও সংশয় গোপন করেননি। আর বেসরকারি বাস-মালিকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, ভাড়া না-বাড়লে কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়।
পরিবহণমন্ত্রী চাইছেন, নাগরিকদের দৈনন্দিন পুর-পরিষেবা জোগানোর পাশাপাশি পুরসভাগুলো এ বার বাস চালানোরও দায়িত্ব নিক। এবং মদনবাবু নিছক ভাবনাতেই আটকে নেই। পুরসভাকে দিয়ে কী ভাবে বাস-পরিষেবা চালু করা যায়, সে ব্যাপারে সবিস্তার রিপোর্ট তৈরি করতে তিনি ইতিমধ্যে পরিবহণ দফতরের কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রীর কথায়, “পুরসভাগুলোকে বাস চালানোর ভার দিতে গেলে নিয়ম-কানুন কিছু বদলাতে হবে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব দিক বিচার করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” পুরসভাগুলো তো জঞ্জাল সাফাই, জল সরবরাহ বা রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের মতো কাজই অনেক সময় ঠিকঠাক করতে পারছে না! এর উপরে তারা বাসও চালাবে কী করে?
তারও সুরাহা বাতলেছেন মদনবাবু। “পুরসভায় বিভিন্ন কাজ দেখভালের জন্য এক-এক জন মেয়র পারিষদ বা চেয়ারম্যান পারিষদ থাকেন। যেমন জল, রাস্তা, নিকাশি ইত্যাদি। পরিবহণেও এক জন পারিষদ রাখা যায়, যিনি এলাকার পরিবহণ-পরিষেবার দিকটা দেখবেন।” মন্তব্য মদনবাবুর। কোনও পুরসভা বাস চালাতে চাইলে পরিবহণ নিগমগুলির ডিপো ও ওয়ার্কশপ ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও জানান তিনি। তাঁর হিসেবে, এই ব্যবস্থায় পুরসভা ও নিগম দু’পক্ষেরই লাভ হবে।
প্রসঙ্গত, এর আগে পরিবহণ-শিল্পের হাল ফেরাতে কর্পোরেট সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছিলেন পরিবহণমন্ত্রী। তাদের দিয়ে পথে বাস নামানোর কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সরকারের ডাকে সাড়া দিয়েছিল সাকুল্যে পাঁচটি কর্পোরেট কোম্পানি, যার তিনটেই ছিল অর্থলগ্নি সংস্থা। স্বভাবতই সে বার মদনবাবুর পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয়নি। তাঁর নতুন ভাবনাটিও কি আদৌ বাস্তবায়িত করা সম্ভব?
বস্তুত সরকারি কর্তামহল থেকে শুরু করে বেসরকারি বাস সংগঠন দু’তরফই এ নিয়ে ঘোরতর সন্দিহান। সংশয়ে রয়েছেন খোদ রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। তাঁর বক্তব্য, “জানি না, পরিবহণমন্ত্রী কী বলেছেন। এ নিয়ে উনি এখনও আমার সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি।” তবে পুরমন্ত্রী নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিচ্ছেন, “পুরসভাগুলোর বাস চালানোর পরিকাঠামো নেই। তাই কোনও পুরসভা এই দায়িত্ব নিতে রাজি হবে না।” রাজ্যের পুর-কর্তাদের পর্যবেক্ষণ, “অনেক পুরসভা জঞ্জাল ফেলার কাজও নিজেরা করতে না-পেরে বাইরের সাহায্য নিচ্ছে। তাদের দিয়ে বাস চালানোর পরিকল্পনা খুবই বিস্ময়কর।”
বেসরকারি বাস-মালিকেরা অবশ্য এত সব তর্কে ঢুকছেন না। ওঁদের সাফ কথা, বাসের ভাড়া না-বাড়ালে কোনও ভাবনাই কার্যকর হবে না। বেসরকারি বাস-মালিক সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস’-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “গত এক বছরে নতুন বাস চালাতে চেয়ে সরকারের কাছে পঞ্চাশটিরও কম আবেদন জমা পড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাসের ভাড়া না-বাড়ালে পরিবহণ-শিল্প বাঁচবে না। এই সার সত্যিটা সরকার বুঝতে চাইছে না।” তপনবাবুর মতে, পুরসভাকে দিয়ে বাস চালানো যেতেই পারে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না।
এ হেন ভাবনা মদনবাবুর মাথায় এল কী ভাবে?
পরিবহণ-সূত্রের ইঙ্গিত, বেসরকারি মালিকদের বাস চালানোয় অনীহা ও ঘন ঘন ধর্মঘটের হুমকি থেকে নিস্তার পেতেই এই ভাবনা। “এক দিকে বেসরকারি মালিকদের ভাড়াবৃদ্ধির দাবি সামলাতে সরকার জেরবার। অন্য দিকে সারা রাজ্যে বাস চালানোর পরিকাঠামো সরকারি নিগমগুলোর নেই। তাই মন্ত্রী পুরসভার দ্বারস্থ হতে চাইছেন।” বলেন পরিবহণ দফতরের এক কর্তা। তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, পুরসভা বাস চালালে সরকারই ভাড়া বেঁধে দেবে। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকদের নিরন্তর চাপ থেকে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে। পরিবহণমন্ত্রীর ইচ্ছেয় শেষমেশ পুর দফতরই জল ঢেলে দেয় কি না, সেটাই দেখার। |