মূল মঞ্চের পাশে পর্দা-ঢাকা একটা জায়গা। রিমোট টিপতেই সরে গেল পর্দা। বেরিয়ে এল সার সার ফলক। একটি-দু’টি নয়, ৮৬টি! একই মঞ্চ থেকে, রিমোট টিপে, ৩১টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৫৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সেরে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার মালদহে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় এসে সরকারি তৎপরতার এমনই ছবি দেখল আমজনতা। প্রশাসনিক কর্তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী একসঙ্গে বহু প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন। তাই এই ব্যবস্থাটি বেছে নেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লোকজন কিন্তু এটুকুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। তাঁদের প্রশ্ন, জনতার দরবারের সরকারি কাজকর্ম ও বার্তা পৌঁছে দিতে প্রযুক্তির এ টুকু ব্যবহারেই কেন থমকে থাকবে বাংলা? মুখ্যমন্ত্রী যেখানকার প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করলেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গেই তো সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হল না!
এমন নয় যে প্রযুক্তির অভাব রয়েছে রাজ্যে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের লোকজন বলছেন, একটু ভাবনা ও তার প্রয়োগই মালদহের ওই মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে একই সময়ে প্রকল্পের এলাকাগুলিতে পৌঁছে দিতে পারত। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে পেতেন ওই সব অঞ্চলের মানুষ। মানুষের প্রতিক্রিয়া সরাসরি দেখতে পেতেন মুখ্যমন্ত্রীও। রাজনীতির তাগিদে প্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহার হচ্ছে দেশে, সরকারি কাজে কেন তেমনটা হবে না, তাদের মূল প্রশ্ন এটাই।
একা নরেন্দ্র মোদী ত্রিমাত্রিক ছবি হয়ে একই সঙ্গে অনেক মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন, গুজরাত তা দেখেছে। এ রাজ্যেও মাইকে-মোবাইলে যুগলবন্দি ঘটিয়ে দূরের সভায় বক্তৃতা করেছেন মমতা বা বিমল গুরুঙ্গেরা। সরকারের কর্মযজ্ঞেও তেমনটা, কিংবা তার চেয়ে ভাল কিছু করা যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক সমীরণ চট্টোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগালে মুখ্যমন্ত্রী এক জায়গা থেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করতে পারেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৌঁছে যেতে পারেন হাজার-হাজার মানুষের কাছে। রাজ্যের প্রতিটি ব্লকস্তরে সেই ধরনের ইন্টারনেট যোগাযোগ ইতিমধ্যেই রয়েছে বলে তিনি জানান।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ইদানীং এ ভাবেই ‘ভার্চুয়াল ক্লাসরুম’-এর চল হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে বসেই পড়ুয়ারা শিক্ষকের পড়া শুনতে পারেন। পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষককেও। রয়েছে ‘মাল্টি লোকেশন ভিডিও কনফারেন্স’ প্রযুক্তিও। যা ব্যবহার করে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ-কর্তারা জেলাশাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এই ধরনের বৈঠক করেছেন কিছু। এখন এর চল বেড়েছে আরও। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই সব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য খুব উন্নত পরিকাঠামোরও প্রয়োজন পড়ে না। সদিচ্ছাটুকু থাকলেই হয়।
রেলমন্ত্রী থাকার সময় মমতা নিজেই শিয়ালদহ বা হাওড়ায় বসে দূরের বহু প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন। রেল সূত্রের খবর, ওই অনুষ্ঠান সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘আউটডোর ব্রডকাস্টিং’ (ওবি) ভ্যান ভাড়া করা হতো। রেলের নিজস্ব টেলিকমিউনিকেশন লাইনের মাধ্যমে মমতার রিমোটের সঙ্কেত পৌঁছত প্রকল্পস্থলে। সরে যেত ভিত্তিপ্রস্তরের পর্দা। কিন্তু রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে তেমন ব্যবস্থা এখনও নেই।
এখন কী ভাবে রাজ্যের প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়?
প্রশাসন সূত্রের খবর, কী কী প্রকল্পের শিলান্যাস বা উদ্বোধন হবে, জেলার বিডিওদের সঙ্গে কথা বলে তার তালিকা তৈরি হয়। তার পর সেই তালিকা ধরে ধরে প্রতিটি প্রকল্পের ফলক তৈরি করে জেলা প্রশাসন। যেগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে, সেগুলোর জন্য আবার আলাদা ফলক। যে প্রকল্পগুলির উদ্বোধন করা হবে, সেগুলিরও আলাদা ফলক তৈরি করান প্রশাসনিক কর্তারা। মুখ্যমন্ত্রী যে দিন জেলায় সভা করতে যান, সে দিন মূল মঞ্চের পাশে সেই ফলকগুলিকে দু’টি আলাদা আলাদা জায়গায় পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে রিমোট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফলকগুলির পর্দা সরিয়ে উদ্বোধন সারেন। মালদহে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন একসঙ্গে ৮৬টি প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করেছেন এ ভাবেই।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগে অনুষ্ঠানের চেহারাটাই বদলে দেওয়া যায়। ফলক টানা-হ্যাঁচড়ার ঝক্কিও পোহাতে হয় না। কী ভাবে?
তথ্যপ্রযুক্তির এক গবেষকের ব্যাখ্যা, মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে একটি ওয়েব-ক্যামেরা লাগানো কম্পিউটার এবং মাইক্রোফোন থাকলেই হল। সেই কম্পিউটারটি হবে সার্ভার। এর সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া হবে বিভিন্ন প্রকল্পস্থলে থাকা কম্পিউটারগুলি। মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলে সভাস্থলে থাকা ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের সাহায্যে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ও বক্তৃতা কম্পিউটারে রেকর্ড হবে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে অন্য কম্পিউটারগুলিতে।
প্রতিটি প্রকল্পস্থলে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে জায়ান্ট স্ক্রিনে বড় করে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা দেখানোও সম্ভব। আবার একই ভাবে প্রকল্পস্থলের ছবিও মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে দেখানো যাবে। “এ জন্য খুবই সাধারণ যন্ত্রপাতি এবং বাজার চলতি ‘জাভা সফটওয়্যার’ দিয়েই এ সব করা যায়,” জানালেন ওই গবেষক।
একই সুর সেক্টর ফাইভের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্তা কল্যাণ করের। তিনি জানান, ‘মাল্টি লোকেশন ভিডিও কনফারেন্স’-এর মাধ্যমেও মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ও বক্তব্য একই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায়ে দেখানো সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক ভাষায় এখন যাকে ‘ওয়েবকাস্ট’ বলা হচ্ছে। অর্থাৎ ইন্টারনেট বা ওয়েবের মাধ্যমে কোনও কিছুর ব্রডকাস্ট বা প্রচার।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স ও টেলিযোগাযোগ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষিকা সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় জানান, ওয়েবক্যামেরা-সহ কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেক দূরের এলাকাতেও যোগাযোগ করা সম্ভব। এই ব্যবস্থা এখন বাজারচলতি উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল ফোনেই মেলে।
বক্তৃতা না হয় সম্প্রচার করা গেল। কিন্তু দূর থেকে বসে ফলকের আবরণ সরানোও কি সম্ভব?
গবেষকরা বলছেন, ‘সেই প্রযুক্তিও রয়েছে।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স বিভাগের এক অধ্যাপকের বক্তব্য, “রিমোট প্রযুক্তিতে দূরত্ব খুব একটা বাধা নয়।” তিনি মনে করিয়ে দিলেন, হিমালয়ের মাথায় বসানো একটি টেলিস্কোপকে রিমোট প্রযুক্তির সাহায্যে বেঙ্গালুরু থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে উৎসাহী রাজ্যের শিল্পমহলও। তাদের বক্তব্য, রাজ্যের নতুন সরকার জেলা শহরগুলিতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার চাইছে। মালদহেও সরকার একটি তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক তৈরির কথা ভাবছে। চলছে সরকারি দফতরগুলিতে ‘ই-গভর্নেন্স’ পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজও। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালে সরকারের সময়পোযোগী ভাবনাটাও মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
মালদহের জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমার বললেন, “প্রযুক্তি ব্যবহারের এই প্রস্তাব খুবই ভাল। ভবিষ্যতে মালদহে মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের অনুষ্ঠান হলে এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করব।”
কী বলছেন রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের কর্তারা?
“এখনই কোনও পরিকল্পনা নেই,” মন্তব্য রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি-সচিব সতীশ তিওয়ারির। |