প্রবন্ধ ২...
বিখ্যাত বাবা আর সুখ্যাত পরিবারের ছায়া
হৃদয়ের যে-সব সুকুমারবৃত্তিকে আমরা মনুষ্যচরিত্রের প্রকৃষ্ট লক্ষণ বলে মনে করি, বাবার মধ্যে সেগুলি ছিল পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু সব কিছু মিলে তাঁর স্বভাব ছিল জটিল ও দুর্জ্ঞেয়।
পিতৃস্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পুরনো সাদা-কালো বাংলা সিনেমার সেই প্রতাপশালী বাবাদের কথা মনে আছে? ‘দেয়া-নেয়া’র কমল মিত্র, ‘সপ্তপদী’র ছবি বিশ্বাস। এঁদের দাপটে দুই সিনেমাতেই ছেলের, ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারের, অবস্থা বেশ ঢিলে। কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন, জবাবদিহি করতে করতে ছেলে জেরবার। পিতা-পুত্রের ‘মেলোড্রামাটিক’ টানাপড়েন অবশ্য আম-বাঙালি টানটান হয়ে উপভোগ করত। থিম হিসেবে বাবা-ছেলের চাপান-উতোরের কোনও মার নেই। সিনেমায় যেমন হয়, বাস্তবে কি তা হয় না? হয়, অন্য রকম ভাবে, কখনও আরও গভীর, আরও জটিল চেহারা নেয় সেই টানাপড়েন। যেমন রবীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছবির কমল মিত্র বা ছবি বিশ্বাসদের মতো প্রবল-প্রতাপ বাবা ছিলেন না। পরনে হাউস কোট, মুখে পাইপ, প্রবাসী বাঙালি শিল্পপতি বাবা কমল মিত্র দেয়া-নেয়া ছবিতে যে ভাবে সুগায়ক পুত্র উত্তমকুমারকে ধমক দেন, গান গাইবার জন্য ব্যঙ্গ করেন, সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথ মোটেই তেমন নন। রবিবাবুর গান তো সকলের প্রিয়। আর তাঁর পিতামহ, ব্যবসায়ী, উদ্যোগপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ সম্বন্ধে গায়ক-কবি রবীন্দ্রনাথের মন খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। সম্পদের চাইতে সংস্কৃতির প্রতিই রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক টান। রবীন্দ্রনাথের সাতাশ বছর বয়সে, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে পুত্র রথীন্দ্রনাথের যখন জন্ম হয়েছে, তত দিনে শুধু কবি হিসেবেই নন, তিনি সুগায়ক হিসেবেও আদৃত। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথা অন দি এজেস অব টাইম-এ কিশোরবেলার স্মৃতি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন পিতার গান গাইবার কথা।
রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী ও পালিতা কন্যা নন্দিনী (পুপে)।
তারকনাথ পালিতের বাড়িতে আত্মতৃপ্ত, ইংরেজিয়ানায় অভ্যস্ত কংগ্রেস নেতাদের ডিনার পার্টিতে ধুতি-চাদর পরা রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না’। বাবা হিসেবে জাত-পাত-ধর্ম ইত্যাদির ‘কুসংস্কার’ থেকেও রবীন্দ্রনাথ মুক্ত। তারাশঙ্করের লেখা থেকে তৈরি ছবি সপ্তপদী’তে বাবা ছবি বিশ্বাস বেজাতের, ভিনধর্মের মেয়েকে পুত্রবধূ রূপে মানতে নারাজ। উদার আধুনিক রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর পুত্রের ‘বিধবা বিবাহ’ দেন। তা হলে?
পুত্র রথীন্দ্রনাথের ওপর পিতার চাপটা অন্য। সে চাপ প্রত্যাশার। সুদর্শন, সুগায়ক, সুকবি, সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথের পুত্র কেমন হবেন, কী করবেন, তা নিয়ে রথীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই ঠাকুর পরিবারে আলাপ আলোচনার শেষ নেই। রথীন্দ্রনাথ তা জানতেন। তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথার গোড়াতেই আছে সে প্রসঙ্গ। রবিকার সন্তান কেমন হবে ছেলে না মেয়ে, হাসিখুশি না সিরিয়াস টাইপ, সমাজ সংস্কারক না ঘরকুনো, হিতেন্দ্রনাথ তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। বলেন্দ্রনাথ রবিকার সঙ্গে এই ‘আসছে’ সন্তানের মিল-বেমিল নিয়ে ফুট কাটছেন। আর এই সব পারিবারিক কৌতুকের দাপটে রথীর মনে হচ্ছে, সে দেখতে ভাল নয়, তার গায়ের রং কালো। লিখছেন রথীন্দ্র, My life thus started with a handicap which gave me a complex that has been difficult to overcome even at a mature age. বিখ্যাত বাবার ছেলে হওয়ার, সুখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়ার কী জ্বালা! সহজাত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স।
অথচ অনেক গুণ ছিল তাঁর। বাংলা ইংরেজি দু’ভাষাতেই চমকার লিখতেন, ছবি আঁকতেন, কাঠের কাজ আর উদ্যানচর্চায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কৃষিবিজ্ঞানের ভাল ছাত্র, খেলাধুলোয় উত্‌সাহী, সংগঠনী ক্ষমতা যথেষ্ট। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় কসমোপলিটান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই ক্লাবের বেসবল টিমের তিনি উত্‌সাহী উদ্যোক্তা। আবার পিতা রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা আর আনুগত্য কিছু কম ছিল না। বিশ্বভারতীর জন্য কত কিছু করেছেন। বিদেশে গবেষক জীবনের ভবিষ্যত্‌ ফেলে দেশে ফিরে পিতার কাজে যোগ দিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন দাশ রথীন্দ্রনাথকে ভারতীয় লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য করতে উদ্যোগী হন, রথীন্দ্রনাথ নারাজ। তাঁর সমস্ত উদ্যম ও সময় নাকি বিশ্বভারতীর জন্য নির্দিষ্ট।
বিশ্বভারতীর প্রতি শ্রদ্ধার একটা নিদর্শন মনে রাখার মতো, তাতে এক স্বাভাবিক উদারতাও প্রতিফলিত হয়। বাবার মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘বাবার personality ঘরের কোণে আবদ্ধ করে রাখবার নয়। তাঁর জীবনের কোনো ঘটনাই চাপা দিয়ে রাখা আমাদের পক্ষে অন্যায়। তাঁর জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা যত প্রকাশ হয় ততই ভাল। আমি মনে করি আমার right নেই কোনো বিষয় লুকিয়ে রাখার। এই জন্যই আমার কাছে যা কিছু mss, চিঠি, cuttings ফোটো diary প্রভৃতি ছিল, সে collection বড়ো কম নয়, আমি একত্র করে museum-এর মতো সাজিয়ে বিশ্বভারতীকে দান করেছি।’
ছেলে তো বাবাকে সকলের জন্য ছেড়ে দিলেন। কিন্তু বাবা? রবীন্দ্রনাথ ‘আশীর্বাদ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পথ দেখাইতে গিয়ে পথ রোধ করি।’ তাই, যে ছোট প্রদীপখানি নিয়ে তিনি আলো দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, অথচ আলোর থেকে যে প্রদীপ ছায়া দিচ্ছিল বেশি, কবি সে প্রদীপ ‘ভেঙে দিনু ফেলে’। কিন্তু পিতা? রবীন্দ্রনাথের নানা সময়ের নানা খেয়াল মেটাতে হয়েছে রথীকে। ‘পুরুষের মন’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন রথীন্দ্র। লিখেছিলেন,
‘ছিল এক সময়
মেয়েদের আঁচলের হাওয়ায় দুলিয়ে দিত মন
তাদের ছোঁয়া গায়ে দিত কাঁটা
...কত জনের মাধুরী চুনে গড়লুম কল্পনার এক মূর্তি,
সব কাজের ফাঁকে উঠতে লাগল মনে
একটি মোহন ছবি।’
রবীন্দ্রনাথ নানা শব্দ যোগবিয়োগ করে লেখাটি শুধরে দিয়েছিলেন। ‘সব কাজের ফাঁকে উঠতে লাগল মনে’, ছেলের কবিতার এই লাইনটি পিতার সংশোধনের পর হল, ‘কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দেয় আর ঢাকা পড়ে’। এ তো যেমন তেমন সংশোধন নয়, উঠে-পড়া মন যেন ঢাকাও পড়ে গেল।
আর তাই হয়তো বাবাকে শ্রদ্ধা করছেন, বাবার জীবন ও কার্যের ইতিহাসকে জনগণের জন্য খুলে দিচ্ছেন পুত্র, কিন্তু জানাতে ভুলছেন না, তাঁর বাবা ‘a most complex charecter’. এই নির্মোহ বিশ্লেষণ কি শুধু বাবা সম্বন্ধেই? আছে অন্যদের কথাও। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন পরিণত বয়সে। অন দি এজেস অব টাইম (ওরিয়েন্ট লংম্যান) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে। রথীন্দ্র স্মৃতিকথায় পরিবারের বর্ণময় গুরুজনদের নিরপেক্ষ ভাবে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথ দ্বারকানাথ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত, রথীন্দ্রনাথ নন। তাঁর কলমে দ্বারকানাথ ‘romantic figure’. আর মহর্ষি? পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন কান্ট আর বেদান্ত পড়া, আপনভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ জানাতে ভোলেননি, দ্বিজেন্দ্রনাথ পার্থিব বিষয়-আশয়ে শিশুর মতো বেখেয়ালি হলেও মহর্ষি মোটেই তেমন নন। রোমান্টিক দ্বারকানাথ, বাবার জটিল চরিত্র, বিষয়ী মহর্ষি, এ-সবই রথীন্দ্র ইংরেজি ভাষায় নিচু স্বরে লিখে ফেলেছিলেন। এ যেন নিজস্ব প্রতিবাদ। বিখ্যাত বাবা আর সুখ্যাত পরিবারের যে অনিবার্য ছায়া তাঁকে ধাওয়া করত, তা থেকে বাইরে আসার চেষ্টা।
জীবনের শেষ পর্বে রথীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন, বলা ভাল, চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, দেহরাদূনে। সেখানে নিজের মতো সময় যাপনের অবসর হয়েছিল তাঁর। শান্তিনিকেতনের জোব্বা ছেড়ে পরতেন শার্ট শর্টস। তবে বাবাকে, বাবার কর্মসাধনাকে ভুলতে চাননি শান্তিনিকেতনের এই ছাত্র। ১৯৬১। পিতার জন্মশতবর্ষ। রথীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য, শতবর্ষ পালনের উত্‌সবে ডাক পাননি প্রতিষ্ঠান থেকে। এ বড় আঘাত। সেই বছরেই পুত্রের প্রয়াণ। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের আলো সারা দেশে, নীরবে চলে গেলেন পুত্র। পিতাপুত্রের এই কাহিনির সঙ্গে কি বাংলা ছায়াছবির তুলনা চলে?

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.