প্রবন্ধ ১...
ইরান: একলা চলা থেকে সবার সঙ্গে
শেষ পর্যন্ত জয় হল কূটনীতির। পরমাণু কার্যসূচি নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে ইরানের কোনও ধরনের বোঝাপড়া যে হতে পারে, কয়েক মাস আগেও তা ছিল কল্পনার বাইরে। এই অন্তর্বর্তিকালীন চুক্তি মাত্র ছ’মাসের জন্য হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এটিকে ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেছেন। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলির কাছ থেকেও।
১৯৭৯ সালে ইরানে যখন শাসক শাহ রেজা পহলভিকে হটিয়ে আয়াতোল্লাহ্ খোমেইনির নেতৃত্বে কট্টর ইসলামপন্থী শাসনকাল শুরু হয়, তখন থেকেই আমেরিকার সঙ্গে ইরানের তীব্র বৈরিতার সম্পর্ক। গত তিন দশকে দুনিয়া এই আশঙ্কায় থেকেছে, কখন আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এক বছর আগে পর্যন্ত আশঙ্কাটা ছিল। সেই নিরিখে গত রবিবারের হওয়া চুক্তিটি সত্যিই একঐতিহাসিক ঘটনা।
ইরানের পরমাণু কার্যসুচির সূত্রপাত ১৯৫০-এর দশকে। আমেরিকার সহায়তায়। তখন আমেরিকা সদ্য একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুতুল শাসক হিসেবে রেজা শাহকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ নামাঙ্কিত প্রকল্পের অধীনে মার্কিন সাহায্যে রেজা শাহ ইরানের পরমাণু কার্যসূচি শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে তুমুল বিক্ষোভের পরিণতিতে শাহ দেশ ছাড়েন আর প্যারিসে নির্বাসনে থাকা ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ্ রুহুল্লা খোমেইনি দেশের সর্বোচ্চ নেতার পদে আসীন হন। ক্ষমতায় আসার পরে তিনি ইরানের পরমাণু কার্যসূচি বাতিল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু ২০০২ সালে শোনা যায়, ইরান তার আগের এক দশক ধরে গোপনে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর পর থেকেই পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে।
অভিনন্দন। জেনিভা চুক্তির সমর্থনে। তেহরান, ২৪ নভেম্বর। ছবি: এ এফ পি।
২০০২ সাল থেকে যা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, ইরান বেশ কিছু দিন ধরে গোপনে পরমাণু প্রকল্প চালু রেখেছিল। লক্ষণীয়, এই তথ্যটি প্রকাশ্যে আসার পরে ইরান অস্বীকার করেনি যে, তারা পরমাণু প্রকল্প চালু করেছে। বরং ইরানের বক্তব্য ছিল, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার পরমাণু কার্যসূচি চালানোর অধিকার আছে; আর, অস্ত্র নির্মাণের জন্য নয়, দেশের বিদ্যুত্‌ ঘাটতি মোকাবিলার জন্য এই প্রকল্প। পশ্চিমী দেশগুলি ইরানের এই যুক্তি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। অচিরেই ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। আমেরিকা আর ইউরোপের দেশগুলি নিঃসন্দেহ ছিল যে ইরানের এই প্রকল্পর মূল উদ্দেশ্য হল পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ। এই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যখন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি বা আই এ ই এ-কে ইরান তার পরমাণু কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করতে দিতে অস্বীকার করে। পশ্চিমের দেশগুলিতে তখন থেকে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যে, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণই ইরানের লক্ষ্য।
শুধু আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলি নয়, পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল আর সৌদি আরব ইরানের এই ‘লক্ষ্য’ নিয়ে খুবই বিচলিত হয়ে ওঠে। মুসলিম দেশগুলি দ্বারা পরিবেষ্টিত ইজরায়েল তার নিরাপত্তা নিয়ে চিরকালই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ওই অঞ্চলে সামরিক ভাবে সর্বাধিক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করে বিগত কয়েক দশক ধরে ইজরায়েল পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার তৈরি করেছে। ইজরায়েলের স্থির বিশ্বাস, নিজেকে পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত করতে পারলে ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করতে পিছপা হবে না। সেই জন্য বারে বারে ইজরায়েল হুমকি দিয়েছে যে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা একতরফা ইরানের পরমাণু প্রকল্পগুলির ওপরে বিমান হামলা করতে পারে, যেমনটি তারা এক সময় সাদ্দাম হোসেনের শাসনাধীন ইরাকের পরমাণু প্রকল্পগুলির ওপর করেছিল। এমন একটি হামলা ওই অঞ্চলকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ভিতর টেনে আনত।
অন্য দিকে, কট্টর সুন্নি ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরবে এই আশংকা দানা বাঁধতে থাকে যে, শিয়া ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র এসে গেলে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে তার প্রভাব কমবে। তাই আমেরিকার মিত্র আর পশ্চিমে বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ সৌদি আরব ওয়াশিংটন-এর ওপর ইরানের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটাতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই আমেরিকা ও বহু পশ্চিমী দেশের সঙ্গে ইরানের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ইরানের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, সেটা বুঝতে পারা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই ইরানকে বাগে আনতে গত দশ বছরে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে এই দেশগুলি ইরানের ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও ইরান তার পরমাণু কার্যসূচি বন্ধ করতে রাজি হয়নি, বরং বারে বারে বলে এসেছে যে, তার পরমাণু প্রকল্প অস্ত্রের সন্ধানে নয়, শান্তির জন্য।
তা হলে বিগত কয়েক মাসে কী ঘটল, যাতে ইরান ছ’মাসের জন্য তার পরমাণু প্রকল্প এগিয়ে না নিয়ে গিয়ে একই জায়গায় ধরে রাখতে আর আই এ ই এ-এর আংশিক পরিদর্শনে রাজি হল?
ইরানের ভিতর সব থেকে বড় যে পরিবর্তন এসেছে, সেটা হল নেতৃত্বের। কট্টর জাতীয়তাবাদী ও পশ্চিম-বিরোধী মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ২০০৫ থেকে এই বছরের মে মাস পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি কোনও ধরনের আপসের পক্ষপাতী ছিলেন না। দেশের ভিতর কয়েক দশক ধরে যে আমেরিকা-বিরোধী আবেগ ছিল, তিনি তার পালে আরও হাওয়া দিয়ে দিয়ে ইরানকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই দেশ পুরোপুরি একলা হয়ে পড়ে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই গত মে মাসের নির্বাচনের গুরুত্ব। সেই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হন মধ্যপন্থী ধর্মযাজক হাসান রুহানি। রুহানিকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে ইরানের জনগণ দেশের ইসলামি নেতৃত্ব আর কট্টরপন্থীদের কাছে এই বার্তা পাঠায় যে, তারা এই আন্তর্জাতিক ভাবে একঘরে হওয়াকে সমর্থন করে না। তা ছাড়া, দীর্ঘকালব্যাপী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেশের অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি মাত্রাছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার আগুন হয়ে ওঠে। দেশের মানুষ তাই তাঁদের নিজেদের জীবনযাত্রার কিছু উন্নতিও চাইছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট রুহানি ক্ষমতায় এসে তাঁর বিদেশমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ঝানু কূটনীতিক মোহাম্মদ জাভেদ জরিফকে। তখন থেকেই আশা জাগে যে, পশ্চিমের সঙ্গে ইরানের পুরোপুরি ভেঙে পড়া সম্পর্ক হয়তো এ বার নতুন করে তৈরি হবে। এবং তা-ই ঘটে। জাভেদ জরিফ তাঁর পুরনো যোগাযোগের মাধ্যমে পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে একটা আলোচনার রাস্তা খোলেন। দেশে পরিবর্তনের হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা চেষ্টা করেন যাতে ইরান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছুটা ছাড় পায়। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হবে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জাভেদ জরিফ এই কাজে সফল হয়েছেন। পরমাণু প্রকল্প স্থিতিশীল রাখা এবং আই এ ই এ-র পরিদর্শনের বিনিময়ে ইরান আগামী ছয় মাসে যা পেল, তাতে দেশের জনগণ খুবই উপকৃত হবেন। রণহুঙ্কারের বদলে কিছুটা ছাড় দিয়ে কিছুটা আদায় করার এই কালজয়ী কূটনৈতিক পন্থায় প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং বিদেশমন্ত্রী জরিফ আজ ইরানকে অনেকটাই নিরাপদ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। এর ফলে পশ্চিম এশিয়া আর একটি সম্ভাব্য সংঘাতের অবস্থান থেকে আপাতত সরে আসতে পেরেছে। কিছু নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে ইরানের অর্থনীতি লাভবান হবে। আগামী ছয় মাস এই চুক্তির শর্ত পালন করে ইরান এটাও প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে যে, তাদের পরমাণু কার্যকলাপ শান্তির জন্যই ছিল। এবং, ইরান এক ঢিলে তৃতীয় আর একটি পাখিও মারতে পারবে। ইরান যে একটি সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটি ওই অঞ্চলে তার দুই প্রধান ‘শত্রু’ দেশ ইজরায়েল ও সৌদি আরবকে এবং আমেরিকার ভিতরেউগ্র ইরান-বিরোধী যে সব গোষ্ঠী আছে তাদের বোঝানোর দায়িত্ব এখন আমেরিকা আর প্রেসিডেন্ট ওবামার ওপর বর্তাবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.